আমার ব্যক্তিগত বেশ কিছু প্রজেক্টে আমি নিজেই নেতৃত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু তার জন্যে কোন নতুন নেতৃত্বের কাউকে আনতে পারছি না। কেন এই ব্যর্থতা? সেটাও পর্যালোচনা করে এই লেখাটি লিখা, অনেকটা আত্মবিশ্লেষণের মতন করে।

মানব সভ্যতার সূচনা থেকেই মানুষকে মূলত দুইটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। একটি শ্রেণী ছিল সামাজিকভাবে সংযুক্ত, যারা এককভাবে কিছু করত না বরং মিলিতভাবে বড় শিকার করত। নৃতত্ববিদরা তার নাম দিয়েছিল নিয়ান্ডারথাল মানব (Homo neanderthalensis) যারা আমাদের পূর্বপূরুষ বলে ধারনা করা হয়। অন্যদিকে, আরেকটি শ্রেণী ছিল যারা একাকী জীবনযাপন করত, তারা শারীরিকভাবে শক্তিশালী এবং কর্মঠ ছিল। তারা একা একা শিকার করত এবং নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা করত। নিতৃত্ববিদরা এর নাম দিয়েছে Homo erectus or Australopithecus। (আমি যতটা সাধারণ ভাবে বললাম, তা নিতৃত্ববিদদের মধ্যে দ্বিমত রয়েছ, তা উল্লেখ করে নিচ্ছি)

তবে নৃতত্ত্ববিদরা বলছেন যে সময়ের সাথে সাথে দেখা যায় যে, কেবলমাত্র সামাজিকভাবে সংযুক্ত ব্যক্তিরা যারা নিয়ান্ডারথাল মানব শুধু তারাই টিকে থাকতে সক্ষম হয়েছে। মানবজাতির ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আমাদের সামাজিক সংযোগ যত বেশি হবে, আমাদের উন্নতি ততই নিশ্চিত হবে।

কেন ধারাবাহিকতা থাকে না?

উদ্দ্যোক্তা বা নেতাদের প্রথম দিকে সেই কনসেপ্টগুলি প্রতিষ্ঠা করার জন্য প্রথমিক ভাবে একাই কাজ করতে হয়। তবে সমস্যা হলো, এই লিজেন্ডরা নতুন কিছু তৈরিতে এতটাই ফোকাস থাকেন যে অনেকেই পরবর্তী নেতৃত্ব তৈরি করার প্রতি মনযোগ দেন না, ফলে তা প্রবাহমান রাখতে ব্যর্থ হন। “একা” উদ্যোগ নিয়ে সেটিকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টার কারণে এটিকে প্রবাহিত করে বহমান রাখাটা কঠিন হয়ে পড়ে।

আমাদের প্রাকৃতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে, কারণ আমরা চিরকাল বাঁচতে পারি না। তাই লিগ্যাসি অব্যাহত রাখার জন্য আমাদের মনোযোগ দিতে হবে কিভাবে আমাদের অর্জিত জ্ঞান ও দক্ষতা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে পৌঁছাতে পারে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, ২০১৮ সালের একটি জরিপে দেখা যায়, দেশের ৭২% তরুণেরা নতুন উদ্যোগ ও নেতৃত্ব তৈরি করতে আগ্রহী, কিন্তু মাত্র ২৮% কার্যকর নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ পায়। সুতরাং, নেতৃত্বের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে সৃজনশীলতা ও নেতৃত্বের শূন্যতা সৃষ্টি না হয়।

নেতৃত্বের উদাহরণ:

আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই, সক্রেটিস তার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এমন একটি ধারা সৃষ্টি করেছিলেন যা তার মৃত্যুর পরেও সারা বিশ্বে বিস্তার লাভ করে। প্লেটো, জেনোফোন, অ্যান্টিসথেনস, অ্যারিস্টিপাস এর মতন মহান চিন্তাবিদরা ছিল সক্রেটিসের ছাত্র। আধুনিক যুগে এটি আরও সহজ হয়ে গেছে, কিন্তু এজন্য প্রয়োজন কৌশল এবং নেতৃস্থানীয় চিন্তাভাবনা।

লিজেন্ডরা কিভাবে ধারাবাহিকতা রাখবেন?

১. ডকুমেন্টেশন: নিজস্ব অভিজ্ঞতা এবং দর্শনগুলো লিখে প্রকাশিত করা খুব প্রয়োজন। এই কাজটি করার জন্য আমাদের প্রচুর লেখালেখি, বই প্রকাশ কিংবা ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করে তা সবার সাথে শেয়ার করতে হবে।

২. কমিউনিটি তৈরি: আপনার চিন্তাধারা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য একটি ফলোয়ার বা কমিউনিটি তৈরি করুন, যারা সমাজের বিভিন্ন অংশে আপনার আইডিয়াগুলো ছড়িয়ে দিতে পারবে।

৩. নেতৃত্বের বিকাশ: ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরির জন্য এক বা একাধিক উপযুক্ত ব্যক্তিকে চিহ্নিত করুন এবং তাদেরকে স্বাধীনভাবে নেতৃত্ব দেবার জন্য স্পেস বা জায়গা দিন, যেন তারা নিজের পদ্ধতিতে সেই লিগ্যাসিকে বহন করতে পারে।

৪. মেন্টরিং করুন: লিগ্যাসি তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মেন্টরশিপ। নেতাদের উচিত কেবল তাদের নিজের অর্জনগুলোর দিকে মনোযোগ না দিয়ে ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গড়ে তুলতে সক্রিয় ভূমিকা রাখা। মেন্টরশিপ ধারাবাহিকতা রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

৫. দর্শন এবং মূল্যবোধের গুরুত্ব: লিগ্যাসি কেবলমাত্র অর্জনের উপর নির্ভর করে না, বরং মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যতের জন্য একটি দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নেতাদের উচিত তাদের মূল্যবোধ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনাগুলি পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করা, যাতে তাদের অনুপস্থিতিতে তাদের অনুসারীরা সেই পথ ধরে চলতে পারে। সেই ক্ষেত্রে নেতাদের উচিত নিজের “আমিত্ব”-কে গুরুত্ব না দিয়ে বৃহৎ আকারে ভবিষ্যতের উপর দৃষ্টি দেওয়া।

৬. ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহার করুন: আধুনিক যুগে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মগুলি লিগ্যাসি ধরে রাখার গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। নেতারা তাদের চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা এবং কাজ ডিজিটাল মাধ্যমে সংরক্ষণ করে যেতে পারেন, যাতে পরবর্তী প্রজন্ম সেগুলো ব্যবহার করতে পারে।

উত্তরাধিকার তৈরির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা