ছুটির দিন মানেই বাঙালি স্টাইলে আড্ডা মারা। গত সপ্তাহে হটাৎ করে ছুটি পাওয়াতে আমরা কয়েকজন মিলে আড্ডাতে বসে গেলাম মোস্তফা এর পাশেই মোহাম্মদী নামে একটি রেস্টুরেন্টে। বৃষ্টিতে পুরে শহর স্নান করলেও আমরা কয়েকজন চা খোর আড্ডাবাজ সেই বৃষ্টিতে হাজির। সেখানে আড্ডার গল্প নিয়ে আজকের নিবেদন।
আমাদের সবার জীবনে কোনো না কোনোভাবে টাকা বা অর্থ জড়িত। আমরা যদিও এখন "ক্যাশলেস সমাজ" এ রূপান্তরিত হচ্ছি, যেখানে ক্রেডিট কার্ড দিয়েই আমরা সব কাজ সারতে পারবো। ভবিষ্যতে হয়তোবা আজকের এই কাগজের টাকা একেবারেই হারিয়ে যেতে পারে। কিন্তু জীবনের প্রয়োজনে"অর্থ" কখনোই হারাবে না। সেটি ভার্চুয়াল হলেও সংখ্যাতে রূপান্তরিত হয়ে কোথাও থাকবে।
"টাকা"- এই ধারণাটি তৈরি করা হয়েছিল মূলত বাণিজ্য বা জিনিসপত্র লেনদেন করার "বিনিময়"সুবিধার জন্য। ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে যারা শুরু হয়েছিল প্রায় ৬ হাজার বছর আগে। কিন্তু বর্তমানে এসে আমরা দেখতে পাচ্ছি যে এই সুবিধাটা নিতে যেয়ে, আমরা নিজেদের অজান্তেই এই অর্থ বা টাকা এর লোভে পড়ে গেছে। আমাদের জীবন জীবিকা সবই হচ্ছে এই "টাকা" কেন্দ্রিক। কে কত টাকা উপার্জন করতে পারে, সেই টাকার লোভে দৌড়াচ্ছি। সামান্য কিছুর টাকার জন্য শরীর স্বাস্থ্য (মানসিক স্বাস্থ্য সহ) নষ্ট করছি, সুন্দর সম্পর্ক গুলো নষ্ট করছি। এমনকি অন্যের জীবন নিয়ে নিতেও দ্বিধা করছি না এই অর্থের জন্য। আমি বলছি না যে অর্থই সমস্ত অনর্থের মূল।। কিন্তু এটা একটা ভীষণ রকমের লোভ আমাদের মধ্যে তৈরি করে ফেলেছে। আড্ডা মারার মধ্যেই একটু মোস্তফা সেন্টারে বাজারের জন্য ঢুকেছিলাম। সেখানে কয়েকজন বৌদ্ধ পুরোহিত কেনাকাটি করবেন। কিছুক্ষণ পরে দেখছি তিনি তার সহকর্মিদের সাথে আফসোস কর বলছেন যে এইখানে জিনিসপত্রের অনেক দাম, তার ব্যাংকের অনেক টাকা চলে গেল, তার সেভিংস কমে গেল। কমে কত হলো?- সহকর্মিটি জিজ্ঞেস করলে তিনি যে অংকটি বললেন তা শুনে আমার মনে হল, সেই জীবনে সেই টাকাটা তার কখনই শেষ করতে পারবেন না। একজন পুরোহিত এর মতন মানুষও টাকার লোভে আবদ্ধ। আমি আমার জীবনে এমন কোন মানুষ দেখিনি যিনি টাকার লোভে আবদ্ধ নন। একজন ভিক্ষুক থেকে শুরু করে সমাজের সবথেকে বড়লোক XX সাহেব। সবাই এই লোভে পড়ে পতিত হয়ে আছেন।
এবার দেখা যাক স্টার্টআপ গুলোর দিকে। স্টার্টআপগুলি আমাদের সমাজের বিভিন্ন সমস্যাগুলোকে সমাধান করার জন্য নতুন নতুন ইনোভেশন নিয়ে কাজ করছে। স্টার্টআপগুলি সাধারণত প্রযুক্তি দিয়ে সেই সমস্যাগুলোকে সমাধান করার চেষ্টা করে। ফেসবুক, ইউটিউব এর মতন স্টার্টআপ গুলো আমাদের সমাজে একটা ভীষণ রকমের বিপ্লব নিয়ে এসেছে। এবং আরো কিছু স্টার্টআপ আসছে যারা আমাদের বিভিন্ন ধরনের সামাজিক ও অর্থনৈতিক সমস্যাগুলোকে সমাধান করছে। কিন্তু পরবর্তীতে দেখা গেছে যে এই স্টার্টআপ গুলো পরিণত হয়েছে মূলত দ্রুত ধনী হওয়ার উপায়। ২০টির মতন স্টার্টআপে ইনভেস্ট করে একটি অন্তত সফল হলে সেই পুরো বিনিয়োগ করা টাকাটি উঠে আসেও আরো কয়েকগুন লাভে নিয়ে আনবে।
স্টার্টআপগুলি বড় বড় কথা বললেও শেষমেষ সবাই অর্থের লোভেই এ কাজগুলো করছে। স্টাটআপগুলো বিভিন্ন ধরনের মুখস্ত কথাগুলি বলে - "সামাজিক সমস্যাগুলোকে" সমাধান করে ভ্যালু প্রদান করার কারণ হিসেবে উল্লেখ করলেও, শেষমেষে দেখা যাচ্ছে যে তারা সেই ভ্যালু বা সামাজিক মূল্য এর থেকে মূলত কিভাবে আরো অর্থ বাড়িয়ে ইনভেস্টারদের বা অর্থ লগ্নীদের পকেটে টাকা দিবে সেই দিকেই মনোযোগটা বেশি। যারা এখানে টাকা ইনভেস্ট করছেন তাদের সর্বশেষ লক্ষ্যই হলো এটাকে বিক্রি করে কিভাবে আরো অর্থ উপার্জন করা। "ভ্যালু"এর পরিবর্তে মূলত অর্থের লোভ টাকেই তাদেরকে বেশি তাড়না দিচ্ছে।
এই ব্যাপারে কথা বলছিলাম আশরাফ জয় ভাইয়ের সাথে। তিনি ভবিষ্যতের স্টার্টআপগুলির একটা অন্যরকম চিত্র কল্পনা করছেন - যেটি আপনাদের সাথে শেয়ার করার জন্যই আমার আজকের লেখা। জয় ভাইয়ের মতে, আমাদের উন্নত দেশগুলোতে স্টার্টআপগুলি একটা স্যাচুরেশন বা পরিপৃক্তি অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সামনে আর ফেসবুকের মতন কোন সামাজিক প্ল্যাটফর্ম হবে না, কিংবা একই রকম কনসেপ্টে অন্য কোন প্ল্যাটফর্ম এর থেকে ভালো কিছু করবে না।
তাহলে ভবিষ্যতের স্টার্টআপগুলি কেমন হবে? জয় ভাইয়ের মতে, উন্নত দেশ নয় বরং বিশ্বের যে সমস্ত দেশগুলো কিংবা অঞ্চলগুলো এখনো অবহেলিত হয়ে আছে, সেই দেশগুলোর সমস্যা সমাধানে স্টার্টআপগুলি এগিয়ে আসবে। স্টার্টআপগুলো সেই অঞ্চলগুলোর সামাজিক সমস্যা সমাধান করে, তারা ভ্যালু বা উপকার করার চেষ্টা করবে এবং সেই ভ্যালু এর পরিমান দিয়ে তাদের সফলতার মানদন্ড হবে। মনে করা যাক কোন একটাই স্টাট আপ বললো যে সে আফ্রিকার শিক্ষার সমস্যাটা সমাধান করার জন্য এই ধরনের প্রযুক্তি নিয়ে এসে তাদের এই পরিমাণ ভ্যালু ক্রিয়েট করবে। এই সমস্ত স্টার্টআপগুলো কেপিআআই (Key Performance Index) বা সফলতার মানদন্ড হবে মূলত কতটুকু তারা ভ্যালু জেনারেট করতে পারছে, তার উপর।
এটি ঠিক যে এই ভ্যালু ক্রিয়েশনের মডেলে অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করলেও, সেই অর্থের লোভ থেকে সেই প্রতিষ্ঠানগুলি কিংবা বিনিয়োগকারিরা এখনো তারা মুক্ত নয়। জয় ভাইয়ের এই ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি কিছুটা আমার মতের সাথে মিলে। আমি মনে করি এই অর্থের লোভ থেকে মুক্ত হয়ে যখন স্টার্টআপগুলো সত্যিকার ভাবে সামাজিক সমস্যা সমাধান করার জন্য ভ্যালু নিয়ে আনবে তখনই একটা নতুন দিগন্ত শুরু হবে। সেই সুন্দর পৃথিবী দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।
আমাদের আড্ডা যখন শেষ হচ্ছে, তখন দেখি বৃষ্টি শেষ হয়ে এল। সিঙ্গাপুরে এখন ইলকট্রিক গাড়ি রেন্ট করার ব্যবস্থা আছে। হটাৎ এ্যাপে একটি নোটিফিকেশন পেলাম যে একটি BlueSG আমার জন্য তারা রিজার্ভ করেছে। সেটি নিয়ে জয় ভাইকে সাথে নিয়ে ড্রাইভ করলাম।
রাতের শুনশান পথ দিয়ে ড্রাইভ করছি আর পাশে জয় ভাই তার জীবনের গল্প বলছে। এই সম্পর্কগুলি কত মধুর। জয় ভাইকে উনার বাসায় ড্রপ করে সেখান থেকে নিজ বাসায় যখন পৌছলাম তখন দেখি মাঝ রাত। বিড়ালের মতন পা ফেলে কোন শব্দ না করে রুমে ঢুকে গেলাম। বিছানায় যেয়ে ভাবলাম, আমার মাথার উপর ছাদ আছে, বিছানায় বৌ আছে, পাশের রুমে আমার সন্তান আছে, ফ্রিজে প্রয়োজনের থেকেও বেশী খাবার আছে। আর সেই আমিও অর্থ এর লোভ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু কৃতজ্ঞতা জানাই সৃষ্টিকর্তাকে এই সুন্দর একটি জীবন উপহার দেবার জন্য, যেখানে শুধু পাবার পরিমাণই বেশী, আর না পাবার পরিমান খুবই কম। তাই ঠিক করলাম এইরকম ভ্যালু ক্রিয়েট করার প্রতি যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান কাজ করছে সেখানে বিনিয়োগ করবো।