প্রকাশিত: 12 Nov 2025

লিংক: https://bangla.bdnews24.com/kidz/100d7f0a75dc

“পৃথিবীর কোথাও ‘মাইগ্র্যান্ট’ শব্দ দিয়ে ব্যান্ড গঠনের ইতিহাস নেই। আমরা সেটাই করতে চেয়েছিলাম।”

ছবি: একটি দলীয় পরিবেশনায় ‘মাইগ্র্যান্ট ব্যান্ড সিঙ্গাপুর’-এর সদস্যরা।

ছবি: একটি দলীয় পরিবেশনায় ‘মাইগ্র্যান্ট ব্যান্ড সিঙ্গাপুর’-এর সদস্যরা।

সিঙ্গাপুরের নির্মাণস্থলে সূর্য ওঠে ভোরেই। কাঁধে বাঁশ, হাতে ইট, কানে ঢুকে পড়ে মেশিনের কর্কশ শব্দ। এই ব্যস্ত শহরের মাটিতেই ঘাম ঝরায় হাজারো বাংলাদেশি শ্রমিক। তাদের বেশিরভাগই সাধারণ মানুষ, কারও পেশা রাজমিস্ত্রি, কেউ ইলেকট্রিশিয়ান, কেউবা টেকনিশিয়ান।

কিন্তু এই ধুলোমাখা মানুষগুলোরই কয়েকজন, সপ্তাহে একদিন, রোববারের সন্ধ্যায় হাতে তুলে নেন অন্যরকম এক যন্ত্র। গিটার, তবলা, বাঁশি কিংবা হারমোনিয়াম। তাদের চোখে জ্বলে ওঠে এক নতুন আলো। এই আলোই জন্ম দিয়েছে এক অনন্য গল্পের ‘মাইগ্র্যান্ট ব্যান্ড সিঙ্গাপুর’।

২০১২ সালে একদল বাংলাদেশি তরুণ একসঙ্গে বসে গান করার সিদ্ধান্ত নেন। কেউ পড়াশোনা শেষ করে কাজের খোঁজে এসেছেন, কেউ বহু বছর ধরে প্রবাসে আছেন। তাদের উদ্দেশ্য খুব সহজ, একটা জায়গা যেখানে তারা ক্লান্তি ভুলে, মন খুলে গান গাইতে পারবেন। তখনও ব্যান্ডের কোনো নাম ছিল না, ছিল না নির্দিষ্ট কোনো ঘরও। খোলা মাঠে বা ডরমিটরির নিচে বসেই শুরু হতো অনুশীলন।পোর্টেবল স্পিকার

২০১৪ সালের দোসরা নভেম্বর। দিনটি আজও তাদের মনে গেঁথে আছে। সেদিনই ব্যান্ডের আনুষ্ঠানিক জন্ম, আর নাম রাখা হলো ‘মাইগ্র্যান্ট ব্যান্ড’। প্রতিষ্ঠাতা নীল সাগর শাহীন ব্যাখ্যা করে বলেন, “মাইগ্র্যান্ট মানে অধিবাসী, পরিশ্রমী মানুষ। পৃথিবীর কোথাও ‘মাইগ্র্যান্ট’ শব্দ দিয়ে ব্যান্ড গঠনের ইতিহাস নেই। আমরা সেটা করতে চেয়েছিলাম।” “এই নামের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এক অনুভূতি, প্রবাসীরা কেবল শ্রমিক নন, তারা সংস্কৃতিরও বাহক”, যোগ করেন শাহীন।

image.png

চলুন জানা যাক এই সুরের নায়কদের। ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা নীল সাগর শাহীন এবং সহ-নেতা সোহেল রানা শুরু থেকেই বিশ্বাস করতেন, গানই পারে দূর প্রবাসে মানুষের মনকে এক সুতোয় বাঁধতে। তাদের সঙ্গে যুক্ত হন রবিউল ইসলাম, সজীব সাহা, উজ্জ্বল কুমার মৈত্র, বজলুর রহমান ও ডালিম হোসেনসহ আরও অনেকে। কেউ তবলা বাজান, কেউ বাঁশি, কেউ গিটার। বর্তমানে ব্যান্ডে আরো যুক্ত হয়েছেন প্রীতম, জনি, মাইনুল, ইমামুল, আলমগীর, মনির, ফরহাদ ও জান্নাত। সবাই মিলেমিশে তৈরি করেন বাংলার সুরের এক সেতুবন্ধন।

রবিউল ইসলাম, যিনি ব্যান্ডের বাঁশিওয়ালা, শোনালেন তার শুরুর গল্প। তিনি বলেন, “আমার বয়স যখন চৌদ্দ-পনেরো, তখন একদিন লালনের সাধুসঙ্গে গিয়েছিলাম। সেখানে এক বাঁশিওয়ালা এমন মুগ্ধ করে বাজাচ্ছিল যে আমি সিদ্ধান্ত নিই, আমিও বাঁশি শিখব।”

আজ সেই কিশোরের বাঁশি সিঙ্গাপুরের আকাশে বাজে, যেখানে শিল্পের সঙ্গে মিশে আছে প্রবাস জীবনের কষ্ট আর মমতা।

আরেক সদস্য উজ্জ্বল কুমার মৈত্র শৈশব থেকেই তবলা বাজাতেন। তার বাবা ছিলেন তার প্রথম শিক্ষক। এখন তিনি অক্টোপ্যাডে বাজান, কিন্তু তবলার তালে তার হাতের গতি এখনো আগের মতোই মসৃণ। তিনি বলেন, “আমরা কেউ পেশাদার শিল্পী নই। কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করি যেন বাংলার গানটা বাঁচিয়ে রাখতে পারি।”

প্রতি সপ্তাহে মাইগ্র্যান্ট ব্যান্ডের কাছে রোববার মানেই উৎসব। এটি সিঙ্গাপুরের সরকারি ছুটির দিন। সপ্তাহে টানা পরিশ্রমের পর এই একদিনই তাদের একমাত্র অবসর। তবে বিশ্রামের বদলে তারা ছুটে আসেন প্র্যাকটিস রুমে। কারও হাতে ড্রামস্টিক, কারও হাতে মাইক্রোফোন, কেউ আবার বাঁশির সুরে মিশিয়ে দেন বাংলার গন্ধ।

image.png