মতামত: উদ্যোক্তা মশিউর রহমান

প্রকাশ: ২৫ অক্টোবর ২০২৫

image.png

বাংলাদেশে এখন অনেক তরুণ-তরুণী স্টার্টআপ বা উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী। এটি সত্যিই আশাব্যঞ্জক। খাবার, অনলাইন কোর্স, পরিবহন ছাড়াও অনেকে চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য নিয়ে নতুন অ্যাপ ও ডিভাইস বানাতে চান। কিন্তু স্বাস্থ্যক্ষেত্রে উদ্যোক্তা হওয়ার কাজে অন্য অনেক স্টার্টআপের মতো সবার আগে ভোক্তা ও ব্যবহারকারীর ‘বিশ্বাস’ বা আস্থা অর্জন প্রয়োজন হলেও তা যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ।

বাংলাদেশ সরকার স্বাস্থ্য খাতে ডিজিটাল ব্যবহারের জন্য একটি পরিকল্পনা করেছে, নাম ‘বাংলাদেশ ডিজিটাল হেলথ স্ট্র্যাটেজি ২০২৩-২০২৭’। এ পরিকল্পনার লক্ষ্য, প্রযুক্তি দিয়ে সবাইকে ভালো স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া। যেমন অনলাইনে রিপোর্ট দেখা, দূর থেকে ডাক্তার দেখানো, ডেটা নিরাপদ রাখা– এসব কাজ নিয়মের মধ্যে আনা। এতে যারা স্বাস্থ্য-অ্যাপ বানাবে, জানবে কোন নিয়ম মানতে হবে, কীভাবে প্রমাণ দেখাতে হবে, রোগীর তথ্য কীভাবে সুরক্ষিত রাখতে হবে। এতে ধীরে ধীরে মানুষের আস্থা বাড়ে।

এবার এশিয়ার কিছু দেশের অভিজ্ঞতাও এখানে বলা যায়। সিঙ্গাপুরের পুরো ডিজিটাল অর্থনীতি খুব শক্তিশালী। তাদের অর্থনীতির প্রায় ১৮ শতাংশ আসে ডিজিটাল খাত থেকে। সেখানে টেক-স্টার্টআপের জন্য ভালো নীতি, স্পষ্ট নিয়ম আর প্রচুর দক্ষ মানুষ আছে। ইন্দোনেশিয়ায় বড় খবর হলো, তাদের অনলাইন বা ডিজিটাল বাজার অনেক বড় হয়েছে। ২০২৪ সালে তাদের ডিজিটাল অর্থনীতির আকার ৯০ বিলিয়ন ডলারের মতো ধরা হয়েছে। আর স্বাস্থ্য-প্রযুক্তির জন্য বিশেষ ‘স্যান্ডবক্স’ চালু করেছে। মানে নতুন স্বাস্থ্য অ্যাপ বা সেবা আগে ছোট পরিসরে, সরকারের নজরদারিতে পরীক্ষা করে দেখা যায়। এটা নতুন দলের ভুল কমায় আর রোগীদের জন্য নিরাপদ হয়। মালয়েশিয়াও স্টার্টআপে এগোচ্ছে। রাজধানী কুয়ালালামপুরের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেমের দাম প্রায় ৪৭ বিলিয়ন ডলার ধরা হয়েছে এবং সরকার স্টার্টআপবান্ধব নানা পরিকল্পনা করছে। বোঝা যায়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় অনেক দেশই ধীরে ধীরে ‘নিয়ম মেনে উদ্ভাবন’-এর পথ বেছে নিচ্ছে।

বাংলাদেশে স্বাস্থ্য স্টার্টআপ করলে তাই কিছু বিষয় মাথায় রাখতে হবে। প্রথমত, উদ্যোক্তাদের তাড়াহুড়ো করে ‘দ্রুত বড় হবো’ ভাবলে চলবে না। যে কোনো স্বাস্থ্য-অ্যাপকে আগে প্রমাণ করতে হবে এটি সত্যি কার্যকর। এই প্রমাণ করে দেখাতে সময় লাগে কিন্তু এটিই আস্থা তৈরি করে।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল হেলথের নীতিমালা আছে। ব্যক্তিগত ডেটার সুরক্ষা নিয়েও নতুন আইন আসছে। স্বাস্থ্য স্টার্টআপের উদ্যোক্তাদের এসব ভালোভাবে বুঝে নেওয়া দরকার। তৃতীয়ত, বাংলায় সহজ নির্দেশিকা, রোগী ও পরিবারের বোঝার মতো শিক্ষাসামগ্রী আর চিকিৎসকদের সহযোগিতা ছাড়া স্বাস্থ্য অ্যাপ জনপ্রিয় হয় না। হাসপাতাল কীভাবে রেফার করে, বীমা থাকলে কীভাবে দাবি করা যায়, তথ্য কাদের সঙ্গে ভাগ করা যাবে– এসবও আগে থেকে ভেবে রাখতে হয়।

চতুর্থত, ‘সত্য কথা’ বলাই সেরা বিজ্ঞাপন। বড় বড় দাবি করলে (যেমন ‘এই বড়িটি খেলেই সব রোগ সারবে!’) প্রথমে মানুষ কৌতূহলী হয় ঠিকই, পরে প্রমাণ না পেলে আস্থা নষ্ট হয়। একবার আস্থা নষ্ট হলে ভালো পণ্যও বিশ্বাস পায় না। তাই ধীরে হলেও সঠিক বলা এবং প্রমাণ দেখানো– এটিই টেকসই পথ।

পঞ্চমত, শুধু কতজন অ্যাপ ডাউনলোড করল বা মাসে কতজন লগইন করল, তা নয়; বরং আমাদের দেখতে হবে কতজন রোগী আসলেই উপকার পেল? হাসপাতালে পুনর্ভর্তি (রিঅ্যাডমিশন) কমলো কি? ওষুধ নিয়ম মেনে খাওয়ার হার (অ্যাডহিরেন্স) বাড়ল কি? কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হলে সেটা রিপোর্ট করার ব্যবস্থা আছে কি? এসব ‘স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ফলাফল’-এর সূচক যত ভালো হবে, স্টার্টআপের সম্মান ও মূল্য তত বাড়বে।

আমাদের তরুণরা খুব দ্রুত শিখছে। কিন্তু টাকার দিক থেকে ২০২৪ সালে বিনিয়োগ কমেছে। তাই সরকার সমর্থিত তহবিল শুরুতে সাহস জোগাতে পারে; পরে বিদেশি বিনিয়োগ এনে প্রকল্প বড় করা যাবে। এ ভিত্তিভূমির ওপর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিজ্ঞতা ভালো ফল তৈরি করতে পারে।

উপসংহারে আবারও বলা যায়, নিয়ম মেনে চললে, রোগীর তথ্য নিরাপদ রাখলে, আর চিকিৎসকদের সঙ্গে জোট বেঁধে কাজ করলে হয়তো রাতারাতি তারকা খ্যাতি আসবে না, কিন্তু কয়েক বছর পর আপনার পণ্যের নামের সঙ্গে ‘বিশ্বাসযোগ্য’ কথাটা ক্রেতা কিংবা ব্যবহারকারীরাই লিখে দেবে। স্বাস্থ্য প্রযুক্তিতে দেশকে টেকসইভাবে এগিয়ে নেওয়ার এটিই পথ।

ড. মশিউর রহমান: লেখক ও বিজ্ঞানী, ওমরন হেলথকেয়ার সিঙ্গাপুরে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত [email protected]