স্বাস্থ্যক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহৃত হয় যাকে আমরা হেল্থটেক বলি, আবার কেউবা একে বায়োমেডিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বলে। বিশ্বের অন্যান্য সেক্টরের মতন এই সেক্টরেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এর প্রয়োগ হচ্ছে বেশ জোরেসোরেই। ওমরণ হেল্থকেয়ারে কাজ করার সুবাদে এশিয়ার দেশগুলির স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ব্যবহৃত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সংশ্লিষ্ট প্রযুক্তিগুলি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করি। চলুন আজকে ইন্দোনেশিয়ার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যক্ষ্মা নির্ণয়ে প্রযুক্তি এর গল্প বলি। ইন্দোনেশিয়ার মধ্য জাভার সেমারাং শহরে যখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত চলমান বা পোর্টেবল এক্স-রে যন্ত্র দিয়ে যক্ষ্মা শনাক্তকরণের কর্মসূচি চালু হলো, তখন থেকেই আমি বিষয়টি গভীর আগ্রহ নিয়ে পর্যবেক্ষণ করছি।

যক্ষ্মা আজও আমাদের এশিয়ার অঞ্চলের জন্য একটি প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২৪ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু ইন্দোনেশিয়াতেই বছরে ১০ লক্ষাধিক যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয় এবং আনুমানিক ১ লক্ষ ২৫ হাজার মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করেন। সংখ্যাটি ভয়াবহ—ভারতের পরই বিশ্বে যক্ষ্মায় আক্রান্ত রোগীর সংখ্যায় ইন্দোনেশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়।

বাংলাদেশের পরিস্থিতিও খুব ভিন্ন নয়। আমাদের দেশে এখনো প্রতিবছর প্রায় ৩ লক্ষ নতুন যক্ষ্মা রোগী শনাক্ত হয় এবং বছরে প্রায় ৪৪ হাজার মানুষ এই রোগে প্রাণ হারান। এমন প্রেক্ষাপটে সেমারাং শহরের যক্ষা রোগী শনাক্তকরণ পদ্ধতি -টি সত্যি আমাকে অবাক করেছে।

এই প্রযুক্তিতে একটি ছোট, বহনযোগ্য এক্স-রে যন্ত্র ঘরে ঘরে গিয়ে রোগ নির্ণয়ের কাজ করছে। আগের মতো বিকিরণরোধী বিশাল আকারের ভ্যান বাড়িতে বাড়িতে নিয়ে যাবার প্রয়োজন হচ্ছে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যুক্ত থাকায় তাৎক্ষণিকভাবে ডিজিটাল ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে, যা সরাসরি জাতীয় যক্ষ্মা পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থায় সংরক্ষিত হচ্ছে। পূর্বে যেখানে এক্স-রের প্রতিবেদন বিশ্লেষণের জন্য সম্পূর্ণভাবে একজন রেডিওলজিস্টের ওপর নির্ভর করতে হতো, সেখানে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত প্রাথমিক ফলাফল প্রদান করছে।

২০২৫ সালের মার্চ থেকে মে পর্যন্ত মাত্র দুই মাসে ২,৭০০ জনকে পরীক্ষা করা হয়েছে এবং তাঁদের মধ্যে ২৭ জন যক্ষ্মায় আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়েছেন। ভাবতে অবাক লাগে—এই রোগীদের যদি দ্রুত শনাক্ত করা না যেত, তাহলে আরও কত মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়তো তা কল্পনাতীত। শনাক্ত হওয়ার পর পরই তাঁদের ছয় মাসের চিকিৎসা শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্যকর্মীরা নিয়মিত তাঁদের খোঁজখবর রাখছেন, কারণ যক্ষ্মার ওষুধ অসম্পূর্ণ রেখে দিলে শুধু রোগ পুনরায় ফিরে আসে না, বরং ওষুধ-প্রতিরোধী বা ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট যক্ষ্মা তৈরি হয়, যা চিকিৎসাকে আরও জটিল করে তোলে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখনো প্রায় এক-তৃতীয়াংশ টিবি রোগী শনাক্তই হচ্ছে না—তারা “মিসিং কেস” হিসেবে থেকে যাচ্ছেন এবং সমাজে অন্যদের সংক্রমিত করছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে যদি আমরা এ ধরনের উদ্যোগ নেই—ধরা যাক একটি জেলায় মাত্র ২,৭০০ জন পরীক্ষা করা হলো এবং ১ শতাংশ রোগী ধরা পড়ল—তাহলে এক জেলায় ২৭ জনকে আগে থেকেই শনাক্ত করা সম্ভব হবে। দেশের ৬৪টি জেলায় একই প্রোগ্রাম চালালে বছরে হাজারো লুকানো রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনা সম্ভব। আর প্রতিটি রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া মানে কয়েকশ জনকে ভবিষ্যতের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।

তবে প্রযুক্তি যেমন নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলছে, তেমনি চ্যালেঞ্জও রয়েছে। একটি বহনযোগ্য এক্স-রে যন্ত্রের মূল্য অনেক। এটি অবশ্যই সামান্য বিনিয়োগ নয়। কিন্তু রোগীদের সঠিক সময়ে চিহ্নিত চিকিৎসা অসম্পূর্ণ রাখার কারণে প্রতিবছর অনেক টাকার ক্ষতি হয়, তখন বুঝতে পারি প্রতিরোধে বিনিয়োগ করা অনেক বেশি ফলপ্রসূ।

আমার কাছে সবচেয়ে মানবিক দিকটি উঠে এসেছে একজন স্থানীয় বাসিন্দা নাসিয়াতিনের অভিজ্ঞতা থেকে। তিনি কয়েক দিন ধরে কাশি এবং বুকে অস্বস্তিতে ভুগছিলেন, মনে করছিলেন হয়তো যক্ষ্মা হয়েছে। কিন্তু দ্রুত এক্স-রে প্রতিবেদন পেয়ে তিনি নিশ্চিত হলেন যে যক্ষ্মা নয়। তাঁর স্বস্তি মুখমণ্ডলে স্পষ্ট ছিল। তিনি বলছিলেন—এই সেবা বিনামূল্যে পাওয়া যায়, শুধু জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে নিবন্ধন করলেই পরীক্ষা করানো সম্ভব।

আমার মনে হয়েছে সেমারাং শহরের এই উদ্যোগ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ, বিশেষত বাংলাদেশের জন্য একটি শিক্ষণীয় উদাহরণ। আমাদের দেশেও যদি যক্ষা শনাক্তকরণ পদ্ধতি চালু করা হয় এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সংযুক্ত চলমান এক্স-রে যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তাহলে প্রতিদিন যেসব অশনাক্ত রোগী লুকিয়ে আছেন, তাঁদের খুঁজে বের করা সম্ভব হবে। আর একবার আমরা রোগীকে চিকিৎসার আওতায় আনতে পারলে সংক্রমণের ভয়াবহ শৃঙ্খল ভাঙাও সম্ভব হবে।

অনেকে হয়তোবা বলবেন ইন্দোনেশিয়ায় যা সহজে করা সম্ভব, তা বাংলাদেশে সম্ভব নয়। আমি মনে করি প্রযুক্তি গ্রহণে কেন জানি আমাদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি কাজ করে - সেটা ভাংঙ্গা দরকার।

তথ্যসূত্র https://govinsider.asia/intl-en/article/semarang-city-uses-ai-powered-mobile-x-ray-for-tb-screening