ড. মশিউর রহমান প্রকাশ: বুধবার ২০ আগস্ট ২০২৫
লিংক: https://bonikbarta.com/editorial/X3nIauHRoQpT6mS6

সিঙ্গাপুরে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করে সিঙ্গাপুরের পাসপোর্ট নিয়ে এখানেই থিতু হয়েছেন জহির ভাই। দীর্ঘদিন মেরিন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করে কিছুদিন আগে রিটায়ার করেছেন। গল্প করার জন্য ফোন করলে জানালেন, তিনি একটি কোর্স করছেন। এই বৃদ্ধ বয়সে আবার কোর্স—বেশ অবাকই হলাম। বাংলাদেশ হলে যেখানে তার অলস সময় পার করার কথা, সেখানে তিনি আবারো নতুন করে পড়াশোনা শুরু করেছেন। জিজ্ঞাস করতেই জানালেন—পাইথন কোডিং শিখছেন। কোর্সের বিস্তারিত জেনে বুঝলাম, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ না হয়েও যতটুকু শিখেছেন তা দিয়ে তিনি ডেভেলপারদের সঙ্গে কমিউনিকেশনটা করতে পারবেন। এই দক্ষতা এখন কাজে লাগানোর কথা ভাবছেন। পরে জানলাম সিঙ্গাপুর সরকার তাদের নাগরিকদের স্কিল ডেভেলপ করার জন্য এই বিশেষ স্কিলফিউচার নামে কোর্সটি শুরু করেছে। সিঙ্গাপুরের আজকের এ উন্নয়নের পেছনে রয়েছে তাদের জনগণের স্কিল ডেভেলপ করার জন্য, জনসম্পদে বিনিয়োগ করা।
এক সময় সীমিত প্রাকৃতিক সম্পদের দেশ সিঙ্গাপুর বুঝে নিয়েছিল—উন্নতির আসল চাবিকাঠি সস্তা শ্রম নয়, বরং উচ্চদক্ষতার মানবসম্পদ। চলুন দেখে নেয়া যাক, কীভাবে তারা জনসম্পদের ওপর সব থেকে বড় বিনিয়োগ করছে এবং এর রিটার্ন পাচ্ছে দেশের সার্বিক উন্নয়নে। তাদের এই এগিয়ে যাওয়ার পেছনে রয়েছে জনগণের জীবনব্যাপী শেখার সংস্কৃতি, প্রযুক্তিনির্ভর প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষা এবং শিল্প-শিক্ষা একীকরণের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ। এ পথচলার কেন্দ্রে রয়েছে তিনটি বড় স্তম্ভ—
প্রথমত, স্কিলফিউচারের (SkillsFuture) মাধ্যমে নাগরিকদের জন্য জীবনব্যাপী শেখার সুযোগ। এ রোডম্যাপ বাস্তবায়নে সিঙ্গাপুর কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছে। সিঙ্গাপুর সরকার ‘ফরওয়ার্ড সিঙ্গাপুর’ নামে একটি উদ্যোগ ঘোষণা করেছে যেখানে প্রত্যেক নাগরিকের জন্য সারা জীবন শেখার ও দক্ষতা উন্নয়নের সুযোগ নিশ্চিত করা হবে। এর মাধ্যমে প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে শেখার জন্য আর্থিক সহায়তা দেয়া হয়, যা সরকার অনুমোদিত হাজারো কোর্সে ব্যবহার করা যায়। জাতীয় দক্ষতা মানদণ্ড অর্থাৎ প্রতিটি দক্ষতার জন্য মান ও মূল্যায়নের কাঠামো নির্ধারণ করেছে, ফলে কোনো সার্টিফিকেটের মান নিয়ে বিভ্রান্তি থাকে না। তারা বুঝেছিল যে বিশ্বমুখী অর্থনীতি গড়তে হলে একটুখানি দ্বীপেও নিজেদের মানুষের মেধা ও দক্ষতায় বিনিয়োগ করতে হবে। আমার পর্যবেক্ষণ হলো তারা শিক্ষাকে কোনো নির্দিষ্ট বয়স বা ডিগ্রির মাঝে আটকে রাখেনি; বরং শৈশব থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত শিক্ষাকার্যক্রমকে চালিত করেছে। সিঙ্গাপুরের এ সিদ্ধান্ত তাদের অর্থনীতিকে শুধু একে অটোমেশন ও উচ্চ প্রযুক্তির দিকে নিয়ে যায়নি, বরং একটি সংস্কৃতি তৈরি করেছে যেখানে ব্যক্তি তার জীবনজুড়ে নতুন দক্ষতা অর্জনে আগ্রহী হয় এবং গর্ববোধ করে।
দ্বিতীয়ত, তারা ‘Work-Study’ প্রোগ্রাম চালু করেছে, যেখানে শিক্ষার্থী প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অংশীদারত্বে কাজ শেখে। প্রোগ্রামের ১০ বছর পূর্তিতে সিঙ্গাপুর পাঁচটি নতুন মডিউল—যুব মানসিক স্বাস্থ্য, ডেটা সায়েন্স, এজাইল ম্যানেজমেন্ট, সবুজ অর্থনীতি ও সাইবার নিরাপত্তা প্রবর্তন করেছে। প্রয়োগভিত্তিক শেখাকে স্কুল পর্যায়ে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, যাতে হাতে-কলমে প্রকল্প, ল্যাব ভিজিট এবং শিল্প খাতের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তৈরি হয়। একই সঙ্গে ওয়ার্ক-স্টাডি মডেলের মাধ্যমে পড়াশোনা ও বেতনভিত্তিক চাকরি একসঙ্গে করার সুযোগ তৈরি হয়েছে, যাতে শিক্ষার্থী গ্র্যাজুয়েশন শেষ করার আগেই উৎপাদনশীল কর্মী হয়ে ওঠে। শিল্প খাতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় করার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর কারিকুলাম হালনাগাদ করতে সাহায্য করেছে। আর ডিজিটাল ট্যালেন্ট পাইপলাইন দক্ষতাভিত্তিক নিয়োগ, বুটক্যাম্প ও মিড-ক্যারিয়ার রিস্কিলিংকে একত্র করেছে, যাতে ডিগ্রির বদলে প্রকৃত দক্ষতা নিয়োগের মাপকাঠি হয়।
এবং তৃতীয়ত, শিল্পভিত্তিক রূপান্তর মানচিত্র বা Industry Transformation Map, যেখানে প্রতিটি অগ্রাধিকার খাতের জন্য দক্ষতার চাহিদা, প্রযুক্তির রোডম্যাপ ও উৎপাদনশীলতার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। এ ক্ষেত্রে তারা ২৩টি অগ্রাধিকার খাতের জন্য দক্ষতা ও প্রযুক্তি রোডম্যাপ তৈরি করেছে, যাতে শিক্ষা ও শিল্পের সংযোগ দৃঢ় হয়। এসব পদক্ষেপের ফলে সিঙ্গাপুরের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞান, গণিত ও পঠনে বারবার শীর্ষ স্থান অর্জন করছে এবং সৃজনশীলতা ও সমস্যা সমাধান দক্ষতায়ও এগিয়ে আছে।
এবার দৃষ্টি ফেরানো যাক বাংলাদেশের দিকে। গত এক দশকে আমরা অনেক টেকনিক্যাল স্কুল ও পলিটেকনিক গড়েছি। বিশ্বব্যাংক সমর্থিত ‘Skills and Training Enhancement Project’ ৭ লাখের বেশি শিক্ষার্থীকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে; প্রোগ্রাম শেষ করার হার ৫০-১০০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে; নারীর অংশগ্রহণ ৫-৩২ শতাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের পাসের হার ৫৫-৯২ শতাংশে পৌঁছেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ জনসম্পদ উন্নয়নের অনেক পদক্ষেপ ও প্রজেক্ট করেছে যার বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়নি। এই সাফল্য আশাব্যঞ্জক, কিন্তু কর্মক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাচ্ছি—অনেকে সার্টিফিকেট পেলেও বাস্তবে দক্ষ নয়। আমাদের সমাজে এখনো কারিগরি শিক্ষাকে তেমন মর্যাদা দেয়া হয় না। মা-বাবারা সন্তানের হাতে সার্টিফিকেট দেখতে চান, কিন্তু কারখানায় হাতে-কলমে কাজ শিখতে পাঠাতে চান না। তাই কলেজের সনদ থাকা সত্ত্বেও অনেক তরুণ চাকরির বাজারে এসে হোঁচট খাচ্ছে। এদিকে সিঙ্গাপুরে টেকনিক্যাল স্কুল ও পলিটেকনিকের গ্র্যাজুয়েটরা বিভিন্ন শিল্পে সহজে চাকরি পায়, কারণ শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান একে অপরের সহযোগী। এছাড়া সরকারও কারিগরি শিক্ষাকে প্রথম শ্রেণীর মর্যাদা দিয়েছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুরের এ মডেলটি হুবহু অনুকরণ করতে পারবে না, বরং প্রেক্ষাপট অনুযায়ী অভিযোজন প্রয়োজন। আমাদের অর্থনৈতিক বাস্তবতা বিবেচনায় প্রথম পদক্ষেপ হতে পারে সীমিত পরিসরে একটি মাইক্রো-লার্নিং ক্রেডিট পাইলট, যা কয়েকটি অগ্রাধিকার জেলা ও খাতে চালু করা হবে। এই ক্রেডিট এনআইডি-ভিত্তিক ডিজিটাল ভাউচার আকারে থাকবে এবং কেবল অনুমোদিত প্রশিক্ষণে ব্যবহার করা যাবে। একই সঙ্গে ওয়ার্ক-স্টাডির (Work-Study) ধাঁচে একটি জাতীয় দক্ষতা ফ্রেমওয়ার্ক প্রণয়ন করা জরুরি, যাতে খাতভিত্তিক দক্ষতা-মান, মূল্যায়ন কাঠামো এবং প্রশিক্ষণ প্রদানকারীর স্বীকৃতি নিশ্চিত হয়। মাধ্যমিক পর্যায়েই ব্যবহারিক ও প্রয়োগভিত্তিক শিক্ষাকার্যক্রম সূচনা করা উচিত, যাতে শিক্ষার্থীরা হাতে-কলমে প্রযুক্তি, ডিজিটাল টুলস এবং শিল্প সমস্যার সমাধান শেখে। ২০২৪ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তি প্রায় ৭ কোটি। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের কর্মসংস্থানের ৪৫ শতাংশ কৃষি খাতে, ১৭ শতাংশ শিল্প খাতে এবং ৩৮ শতাংশ সেবা খাতে নিয়োজিত ছিল। এই পরিসংখ্যানগুলো ইঙ্গিত দেয় যে যদিও সেবা খাত ক্রমবর্ধমান, তবে কৃষি ও শিল্প খাতেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক কর্মজীবী রয়েছেন যাদের দক্ষতা উন্নয়নের প্রয়োজন। বাংলাদেশে ওয়ার্ক-স্টাডি মডেলও বড় সম্ভাবনা তৈরি করতে পারে। শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের যৌথ কারিকুলামে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি কাজের অভিজ্ঞতা অর্জন করবে, আর সরকার কর-প্রণোদনা ও ন্যূনতম স্টাইপেন্ডের মাধ্যমে এই মডেলকে উৎসাহিত করবে।
তবে এই পরিকল্পনার পথে একাধিক বাধা দাঁড়িয়েছে। আমাদের নিয়োগ ব্যবস্থা এখনো পরিচিতি ও রাজনৈতিক সুপারিশনির্ভর; দক্ষতার যথাযথ মূল্যায়ন কম। অনেক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে মডার্ন সরঞ্জাম নেই; শিক্ষাক্রম পুরনো এবং শিক্ষক ঘাটতি আছে। তাই স্বচ্ছ নিয়োগ, আধুনিক সরঞ্জামের জোগান ও প্রশিক্ষকদের উন্নয়ন অপরিহার্য। পাশাপাশি দরকার একটি ডিজিটাল ডেটা প্লাটফর্ম, যেখানে প্রতিটি কোর্সে অংশগ্রহণ, চাকরি লাভের হার ও গড় বেতন প্রকাশিত থাকবে। সিঙ্গাপুরের স্কিলফিউচার ওয়েবসাইট এ কাজটি করে; তথ্যের উন্মুক্ততা শিক্ষার্থী ও নিয়োগদাতাকে সচেতন সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে। পাশাপাশি কয়েকটি অগ্রাধিকার খাতে যেমন লজিস্টিকস, তৈরি পোশাক, হেলথকেয়ার, কৃষি-ভ্যালুচেইন ও আইটি/ডিজিটাল সেবার ক্ষেত্রে রোডম্যাপ প্রণয়ন প্রয়োজন। এতে উৎপাদনশীলতার লক্ষ্য, দক্ষতার মানচিত্র, প্রযুক্তি ব্যবহারের রূপরেখা এবং বার্ষিক অগ্রগতি মূল্যায়ন স্পষ্ট হবে। এ ধরনের উদ্যোগ বাংলাদেশের জন্য কেবল কর্মসংস্থানের মান উন্নয়ন করবে না, বরং আমাদের অর্থনীতিকে দক্ষ জনগণ ও উচ্চমূল্য সংযোজন খাতে রূপান্তর করবে। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে মানুষের বিনিয়োগই সর্বোচ্চ রিটার্ন দেয়। এখন দরকার সেই বিনিয়োগকে আমাদের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে সাশ্রয়ী, ডিজিটাল—প্রথম এবং শৃঙ্খলাপূর্ণ উপায়ে বাস্তবায়ন করা।
সিঙ্গাপুরে সরকার, নাগরিক ও শিল্প মিলে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ঠিক করেছে যেখানে শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়নে সবাই দায়বদ্ধ। বাংলাদেশেও এমন একটি সমঝোতা দরকার। নাগরিক হিসেবে আমাদের শেখাকে জীবনের অংশ হিসেবে নিতে হবে; শিল্পকে প্রশিক্ষিত লোক নিয়োগের অঙ্গীকার করতে হবে এবং সরকারকে স্বচ্ছতা ও মান নিয়ন্ত্রণের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আমাদের তরুণরা আজ ইউটিউব, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অনলাইন কোর্সে নিজেদের দক্ষ করে তুলছে। তারা যদি রাষ্ট্রের সুশৃঙ্খল নীতির সহায়তা পায়—মাইক্রো ক্রেডিট, ওয়ার্ক-স্টাডি ও তথ্যভিত্তিক দক্ষতা রোডম্যাপ—তবে আগামী এক দশকে আমরা এমন এক প্রজন্ম পাব যারা শুধু সার্টিফিকেট নয়, সত্যিকারের দক্ষতা ও উদ্ভাবনের মাধ্যমে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। শেষ পর্যন্ত, সিঙ্গাপুর আমাদের দেখিয়েছে যে মানবসম্পদে বিনিয়োগই সর্বোচ্চ রিটার্ন। আমাদের কাজ এখন এটিকে নিজের পরিসরে রূপান্তর করা, যাতে বাংলাদেশও তার মানুষের শক্তির ওপর ভর করে একটি জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে রূপ নিতে পারে।
শুরুটা ছোট হলেও যদি নীতি-প্রণোদনা, ডেটা-শাসন ও শিল্প-অংশীদারত্বের কাঠামো দৃঢ় হয়, তাহলে আগামী তিন বছরের মধ্যেই আমরা দেখতে পাব—নিয়োগদাতারা কেবল সনদ নয়, প্রকৃত দক্ষতার খোঁজ করছেন; তরুণরা বুঝছে শেখা কখনো শেষ হয় না এবং আমাদের শিল্প খাত সময়মতো ও মানসম্পন্ন উৎপাদনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এটাই হবে টেকসই ও বুদ্ধিদীপ্ত বিনিয়োগ।
ড. মশিউর রহমান: তথ্যপ্রযুক্তিবিদ এবং লেখক; বর্তমানে সিঙ্গাপুরে ওমরন হেলথকেয়ারে ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত