ড. মশিউর রহমান প্রকাশ: রোববার ৩ আগস্ট ২০২৫

লিংক: https://bonikbarta.com/editorial/92P2eZoEzzR3D3ja

election.pdf

image.png

একবিংশ শতাব্দীর এ দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিস্তার করছে। রাজনীতি ও নির্বাচন প্রক্রিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়।

একবিংশ শতাব্দীর এ দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) মানবজীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিস্তার করছে। রাজনীতি ও নির্বাচন প্রক্রিয়াও এর ব্যতিক্রম নয়। যেখানে একদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্বাচন পরিচালনায় দক্ষতা বৃদ্ধি এবং ভোটারদের অংশগ্রহণে নতুন মাত্রা যোগ করার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে, অন্যদিকে এটি ভুল তথ্য ছড়ানো, জনমতকে প্রভাবিত করা এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করার ঝুঁকিও তৈরি করছে।

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার একটি জটিল এবং বহুমাত্রিক বিষয়। বিশ্বজুড়ে নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ক্রমেই বাড়ছে, যা নির্বাচনী প্রচারণার ধরন, ভোটারদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তথ্যের প্রবাহকে গভীরভাবে প্রভাবিত করছে। এ প্রবণতাগুলো একদিকে যেমন নতুন সুযোগ তৈরি করছে, তেমনি অন্যদিকে গুরুতর চ্যালেঞ্জও নিয়ে আসছে। এর ক্ষমতা যেমন সুদূরপ্রসারী, তেমনি এর অপব্যবহারের পরিণতিও মারাত্মক হতে পারে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন দেশ তাদের নির্বাচনী ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব মোকাবেলায় নতুন নতুন কৌশল এবং আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছে। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এ অভিজ্ঞতাগুলো থেকে শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে যেখানে ডিজিটাল বিভাজন এবং মিডিয়া সাক্ষরতার অভাব এখনো একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

প্রথমত, ভুল তথ্য ও ডিপফেক আমাদের জন্য সব থেকে ভয়ের কারণ। নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সবচেয়ে উদ্বেগজনক ব্যবহারগুলোর মধ্যে একটি হলো ভুল তথ্য এবং ডিপফেক তৈরি ও প্রচার। ডিপফেক হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি করা নকল ছবি, ভিডিও বা অডিও, যা এতটাই বাস্তবসম্মত যে আসল থেকে নকল পার্থক্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। উদাহরণস্বরূপ ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির একটি ডিপফেক ভিডিও ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে তাকে সৈন্যদের অস্ত্র ত্যাগ করার নির্দেশ দিতে দেখা যায়। যদিও এটি দ্রুতই ভুয়া প্রমানিত হয়েছিল, তবে এ ধরনের ঘটনা তথ্যের পরিবেশকে দূষিত করে এবং জনগণের মধ্যে অবিশ্বাস তৈরি করে। ২০২৪ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনেও ডিপফেক এবং এআই জেনারেটেড ভুল তথ্যের ব্যবহার একটি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রার্থীরা একে অন্যের বিরুদ্ধে ভুয়া অডিও বা ভিডিও ক্লিপ ব্যবহার করে ভোটারদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছেন। এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সম্মানহানি করা, ভুয়া বিবৃতি প্রচার করা এবং নির্বাচনী ফলাফলকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগতকৃত প্রচারণা ও ভোটারদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটারদের সম্পর্কে বিশাল পরিমাণ ডেটা বিশ্লেষণ করতে সাহায্য করছে। এ ডেটা ব্যবহার করে ভোটারদের পছন্দ-অপছন্দ, রাজনৈতিক প্রবণতা এবং এমনকি তাদের ব্যক্তিগত দুর্বলতাও চিহ্নিত করা সম্ভব হচ্ছে। ফলে রাজনৈতিক দলগুলো অত্যন্ত ব্যক্তিগতকৃত বা পারসোনালাইজড বার্তা তৈরি করতে পারছে, যা নির্দিষ্ট ভোটার গোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে পাঠানো হয়। এ ব্যক্তিগতকৃত প্রচারণার মাধ্যমে ভোটারদের কাছে আরো প্রাসঙ্গিক তথ্য পৌঁছানো সম্ভব হলেও এর মাধ্যমে ভোটারদের ম্যানিপুলেট করার ঝুঁকিও থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যালগরিদমগুলো এমনভাবে ডিজাইন করা হতে পারে, যা ভোটারদের শুধু তাদের পছন্দের তথ্য দেখায়, ফলে তারা ভিন্নমত বা বিকল্প দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বঞ্চিত হয়। এটি তথ্যের মুক্ত প্রবাহে বাধা তৈরি করে এবং রাজনৈতিক মেরুকরণকে বাড়িয়ে তোলে।

তবে শুধু নেতিবাচকই নয়, পাশাপাশি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ইতিবাচক কাজেও ব্যবহার করে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার উন্নতি হতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কিছু ইতিবাচক ব্যবহারও রয়েছে, যা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে আরো দক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পারে:

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে ভুয়া খবর এবং ভুল তথ্য শনাক্ত করা সম্ভব। বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষক এমন টুল তৈরি করছেন, যা এআই জেনারেটেড কনটেন্ট চিহ্নিত করতে পারে। যদিও এ টুলগুলোর কার্যকারিতা এখনো সীমিত, তবে ভবিষ্যতে এগুলো ভুল তথ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সেন্টিমেন্ট অ্যানালাইসিস ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং অন্যান্য উৎস থেকে জনগণের মনোভাব বিশ্লেষণ করা যায়। এটি রাজনৈতিক দলগুলোকে জনগণের চাহিদা ও উদ্বেগ সম্পর্কে ধারণা পেতে সাহায্য করে, যা তাদের নীতিনির্ধারণে সহায়ক হতে পারে। এছাড়া কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নির্বাচন পরিচালনায় দক্ষতা বাড়াতে পারে, যেমন ভোটার তালিকা ব্যবস্থাপনা, ভোট কেন্দ্রের লজিস্টিকস অপ্টিমাইজ করা এবং নির্বাচনী ব্যয় অনুমান করা।

তবে এ ইতিবাচক ব্যবহারগুলো এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে এবং এর পূর্ণ সম্ভাবনা উপলব্ধি করতে আরো গবেষণা ও উন্নয়নের প্রয়োজন। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা যেমন বাড়ছে, তেমনি এর অপব্যবহার রোধে কঠোর নৈতিক নির্দেশিকা ও নিয়ন্ত্রক কাঠামো তৈরি করা অপরিহার্য।

বাংলাদেশের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে, সেখানে নির্বাচনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রভাব একটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। এখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জগুলো বৈশ্বিক প্রবণতা থেকে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে, বিশেষ করে মিডিয়া সাক্ষরতা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার এবং ডিজিটাল আইনের প্রেক্ষাপট আমাদের দেশে ভিন্ন।

বাংলাদেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করে এবং এদের শতকরা ৭০ জনই সোশ্যাল মিডিয়ায় সক্রিয়। ফলে বিভ্রান্তিকর তথ্য দ্রুত ছড়ানোর সুযোগ বেশি। একটি মাত্র মিথ্যা ভিডিও কোটি মানুষকে অনায়াসে প্রভাবিত করতে পারে। অনেক ভোটারই ডিজিটাল জগতে তথ্য যাচাই করতে অভ্যস্ত নয়। তারা সাধারণত প্রচলিত সোশ্যাল মিডিয়ার খবরগুলো পরীক্ষা না করেই বিশ্বাস করে। এ কারণে ভুয়া ভিডিও বা পোস্ট দেখে তারা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে।

বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন থাকলেও তাতে স্পষ্টভাবে ডিপফেক বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক নির্বাচনী মিথ্যার কথা বলা হয়নি। নির্বাচন কমিশন এখনো এআই প্রযুক্তির ব্যবহারের জন্য কোনো বিশেষ নির্দেশনা দেয়নি, ফলে প্রচারণায় যেকোনো কনটেন্ট ব্যবহার করা যায়।