বছর-খানেক পরে ২০১০ এর দিকে আবার আমার প্রফেসর আবারও গবেষনা করার জন্য ডাক দেন। যন্ত্রটির ইলেকট্রনিক্স এর কিছু কাজ শেষ করার জন্য আমাকে অনুরোধ করেন। প্রফেসরের অনুরোধে পুনরায় কাজটি গ্রহণ করি। এই ১০ বছরে জাপানে আমার প্রফেসরের ল্যাবে এই সংক্রান্ত কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গেলেও সরাসরি সার্কিট দিয়ে পরিমাপ করা সম্ভব হয়ে উঠেনি। ছয়টি মাস ধরে কাজ করে ইলেকট্রনিক্সের সার্কিটটির মোটামুটি একটি রূপ দিই। প্রায় এক বছর কাজ করার পরে প্রথম আমার হাতের সার্কিট দিয়ে সিগনাল গ্রহণ করা সম্ভব হয়ে উঠে। আমরা নতুন এই প্রযুক্তির নাম দিই প্লানার প্যাচ ক্ল্যাম্প। এই সংক্রান্ত একটি রিপোর্টের লিংক পাবেন এইখানে

(কোষের যোগাযোগ ব্যবস্থা জানার জন্য প্যাচক্লাম্প যন্ত্র আবিষ্কার করেন প্রোফেসর এরউইন নেহার নোবেল পুরষ্কার পান। পাশাপাশি এই প্রবন্ধের লেখকও এই যন্ত্রটি তৈরির গবেষণা করেন। লেখকের অভিজ্ঞতার আলোকে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। )

দিনের শেষে বিকেলে সিঙ্গাপুরের ট্যাক্সি পাওয়া বেশ কঠিন। এই সময়ে কাজ শেষে বাড়ি ফেরার লোকজনের চাপ একটু বেশীই থাকে। তবে কিছুদিন আগে আমার মোবাইলে ট্যাক্সি রিজার্ভ করার একটি এ্যাপ ইন্সটল করেছিলাম। সেই এ্যাপসের কল্যাণে খুব সহজেই ট্যাক্সি রিজার্ভ করে ফেললাম। আমাদের গবেষণাগারের সবাই মিলেই ট্যাক্সিতে করে রওনা দিলাম।

আমরা যখন সিঙ্গাপুর সাইন্স সেন্টারে পৌঁছলাম তখন বিকেল শেষ হয়ে আসছে। ১৯৭৭ সনে স্থাপিত এই সাইন্স সেন্টারটি গড়ে উঠেছে মূলত কিশোর কিশোরীদের জন্য। তাদেরকে বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয়গুলি সহজভাবে তুলে ধরার জন্য এবং বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহী করে তুলার জন্যই এই বিজ্ঞানের যাদুঘরটি। তবে আজকে আমরা বিজ্ঞান সম্বন্ধে জানতে আসিনি, এসেছি এরউইন নেহার (Erwin Neher) নামে পৃথিবীর বিখ্যাত একজন বৈজ্ঞানিকের কথা শুনবার জন্য।

এরউইন নেহার ও স্যাকম্যান প্যাচ ক্ল্যাম্প প্রযুক্তির উদ্ভাবন করেন এবং ১৯৯১ সনে নোবেল প্রাইজ অর্জন করেন। যখন তিনি এই নোবেল প্রাইজ গ্রহণ করেন তখন আমি রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে পড়াশুনা করছিলাম। অথচ তখন জানতেই পারিনি এই প্রযুক্তিটিই আমার জীবনে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে যাবে। মূল গল্পে আসার আগে একটু সহজ ভাষায় বুঝিয়ে বলি এই প্রযুক্তিটি সম্বন্ধে।

(ছবি: প্রোফেসর এরউইন নেহের এর সাথে লেখক)

(ছবি: প্রোফেসর এরউইন নেহের এর সাথে লেখক)

চিত্র: আমাদের শরীরের স্নায়ুর যোগাযোগ ব্যবস্থা (সূত্র: iahealth.net)

চিত্র: আমাদের শরীরের স্নায়ুর যোগাযোগ ব্যবস্থা (সূত্র: iahealth.net)

আমরা জানি যে জীব-জন্তুর শরীর অসংখ্য কোষ দিয়ে গঠিত। এই কোষগুলি সবসময় একে অপরের সাথে যোগাযোগ করে চলে। বিশেষ করে স্নায়ুর মধ্যের যোগাযোগগুলি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে স্নায়ুগুলি বার্তা বহন করে মস্তিষ্কে নিয়ে পৌছায়, এবার মস্তিষ্ক থেকে বার্তা শরীরের বিভিন্ন স্থানে পৌছায়। এদের কল্যাণেই আমরা হাত-পা নাড়াতে পাড়ছি। বাহিরে আলো চোখের মাধ্যমে দেখা থেকে শুরু করে আহত হবার খবরও মস্তিষ্কে পৌঁছানোর জন্য এই যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মানুষ অনেক আগেই এই যোগাযোগ এর সম্বন্ধে জানতো। কিন্তু কোন প্রযুক্তি না থাকার কারণে সেই যোগাযোগ এর পদ্ধতির সরূপ ও কিভাবে এটি কাজ করে তা বিস্তারিত জানা সম্ভব হয়ে উঠেনি। নেহার ও স্যাকম্যান কোষের এই যোগাযোগ ব্যবস্থা জানা ও পরিমাপ করার জন্য একটি যন্ত্র আবিষ্কার করেন যা প্যাচ ক্ল্যাম্প নামে পরিচিত। কোষগুলির যোগাযোগের সময় বিভিন্ন ধরনের আয়ন ব্যবহৃত হয়, এবং খুবই অল্প পরিমাণে বিদ্যুৎ পরিবাহিত হয়, যার পরিমাণ পিকো অ্যাম্পিয়ার একক। ১,০০০,০০০,০০০,০০০ (বারোটি শূন্য) পিকো অ্যাম্পিয়ার এক অ্যাম্পিয়ার হয়। এইরকম সূক্ষ্ম বিদ্যুতের তারতম্য পরিমাপ করে প্যাচ ক্ল্যাম্প কোষের যোগাযোগের পদ্ধতি পরিমাপ করতে পারে। যেন অন্ধকার ঘরে ক্ষুদ্র আলোর ঝলক মাপা।

তাদের এই আবিষ্কার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এই আবিষ্কারের পরেই মানুষের সামনে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়। তাদের আবিষ্কারের পরেই বিজ্ঞানীরা কোষগুলির মধ্যে যোগাযোগের একটি অদ্ভুত নেটওয়ার্ক আবিষ্কার করেন। আবিষ্কার করেন কিভাবে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিন গুলি এই যোগাযোগের ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। বৈজ্ঞানিকের এই যোগাযোগ পদ্ধতিকে বলেন আয়ন চ্যানেল। বিভিন্ন চ্যানেলের মধ্যে আয়নের মাধ্যমে এই যোগাযোগ হয় হলেই এমন নামটি রাখা হয়েছে।

চিত্র: স্নায়ুর যোগাযোগ (সূত্র: Fischbach, 1992, p. 52 )

চিত্র: স্নায়ুর যোগাযোগ (সূত্র: Fischbach, 1992, p. 52 )

এবার আসার যাক আমার গল্পে। ছেলেবেলা থেকেই আমার যন্ত্রপাতি তৈরি করার প্রতি আগ্রহ এবং সেই আগ্রহই ধীরে ধীরে আমার পেশার ভিত্তি হয়ে ওঠে। জাপানে মাস্টার্স করার সময় আমার হাতে আসে অনুপরমাণু পর্যবেক্ষণের যন্ত্র Scanning Tunneling Microscope তৈরির সুযোগ। সেই অভিজ্ঞতাই আমাকে আরও গভীরভাবে গবেষণার প্রতি অনুরাগী করে তোলে।

পরে পিএইচডি চলাকালে প্রফেসর এরউইন নেহারের উদ্ভাবিত প্যাচ ক্ল্যাম্প প্রযুক্তি নিয়ে আমি গভীর আগ্রহ অনুভব করি। এই যন্ত্রে একবারে একটি মাত্র কোষ নিয়ে পরীক্ষা করা যায়; অনেক কোষ একসাথে দ্রুত বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। ফলে ঔষধ গবেষণা কিংবা অন্যান্য কাজে এটি সময়সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। তখন আমার মনে হয়েছিল, ন্যানোপ্রযুক্তি ব্যবহার করে প্যাচ ক্ল্যাম্পকে আরও উন্নত করা যেতে পারে—যাতে কোষের সিগনাল দ্রুত ও কার্যকরভাবে মাপা সম্ভব হয়।

২০০১ সালের দিকে আমি নেহারের উদ্ভাবিত যন্ত্রটি সেমিকন্ডাক্টরের মাধ্যমে ক্ষুদ্র আকারে তৈরির সম্ভাবনা নিয়ে একটি গবেষণা প্রস্তাব জাপানে প্রফেসর উরিসুর কাছে উপস্থাপন করি। তিনি তখনই সতর্ক করেছিলেন যে এটি সহজ কাজ হবে না। আবেগের টানে আমি কাজ শুরু করলেও অল্পদিনের মধ্যেই উপলব্ধি করি, আসলেই কোষের কার্যপ্রণালী কতটা জটিল এবং সেখান থেকে সঠিকভাবে সিগনাল সংগ্রহ করা কত কঠিন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল মানুষের তৈরি ইলেকট্রনিক সার্কিটকে জীবন্ত কোষের সাথে কার্যকরভাবে যুক্ত করা।

তবুও আমি নিরুৎসাহিত হইনি; গবেষণা চালিয়ে গিয়েছি। অবশেষে ২০০৪ সালে সেমিকন্ডাক্টরের মাধ্যমে স্নায়ুর সিগনাল সফলভাবে রেকর্ড করতে সক্ষম হই। এ নিয়ে আমরা একটি গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করি (লিংক)। এ ক্ষেত্রে আমরা ছিলাম বিশ্বের প্রথম সফল গবেষক দল। এই সাফল্যের ভিত্তিতেই আমার পিএইচডি সম্পন্ন হয়। পরবর্তীতে আমি যুক্তরাষ্ট্রে এবং পরে বাংলাদেশে ফিরে এসে তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করি।

লেখকের তৈরি কোষের সিগনাল পরিমাপের যন্ত্র (২০০৫ সনের পিএইচডি থিসিস থেকে সংগ্রীহিত)

লেখকের তৈরি কোষের সিগনাল পরিমাপের যন্ত্র (২০০৫ সনের পিএইচডি থিসিস থেকে সংগ্রীহিত)

নেহার এর যন্ত্রটি সরাসরি কোষকে প্যাচ করে সেখান থেকে সিগনাল গ্রহণ করে। তার যন্ত্রের পুরো ব্যাপারটি হল অনেকটি ম্যানুয়াল ধরনের। অর্থাৎ হাতে হাতে একটি একটি করে কোষের সিগনাল পরিমাপ করা যায়। একসাথে কয়েকটি কিংবা হাজার খানেক কোষের সিগনাল সম্বন্ধে জানা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। সেই সমস্যাটি আমরা আমাদের যন্ত্রে তুলে ধরার চেষ্টা করি। প্ল্যানার প্যাচ ক্ল্যাম্পে সেমিকন্ডাক্টরের প্রযুক্তি ব্যাবহার করে এক সাথে অসংখ্য হাজার থেকে শুরু করে মিলিয়ন পরিমাণের কোষের সিগনাল গ্রহণ করা সম্ভব হবে। তবে পৃথিবীতে আমরাই এটি তৈরি করছি তা কিন্তু নয়। আমাদের পাশাপাশি আরও দশ-বারোটি গবেষণাগারে একই ধরনের যন্ত্র তৈরি করার কাজ হচ্ছে। অদূর ভবিষ্যতে আরও সহজে কোষগুলির সিগনাল সম্বন্ধে আমরা জানতে পারবো।

কেন এই প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ

প্যাচ ক্ল্যাম্প প্রযুক্তি শুধু একটি যন্ত্র নয়; এটি আধুনিক জীববিজ্ঞানের এক বিপ্লব। কোষের সূক্ষ্ম বৈদ্যুতিক সিগনাল সরাসরি পরিমাপ করার সুযোগ দেওয়ার ফলে আমরা জানতে পেরেছি, কোষ কীভাবে বার্তা আদানপ্রদান করে এবং কোন প্রোটিন বা আয়ন চ্যানেল সেই প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখে। এই জ্ঞান থেকে আজকের ওষুধ আবিষ্কারের পদ্ধতি আরও উন্নত হয়েছে।

বিশেষ করে পারকিনসন, আলঝেইমার কিংবা হান্টিংটন রোগের মতো স্নায়বিক ব্যাধি বোঝা ও তার চিকিৎসা পদ্ধতি উদ্ভাবনে এই প্রযুক্তির অবদান অপরিসীম। কারণ এসব রোগের মূল সমস্যা হলো নিউরনের যোগাযোগ ব্যাহত হওয়া। প্যাচ ক্ল্যাম্প প্রযুক্তির মাধ্যমে আমরা সেই ব্যাহত প্রক্রিয়াটি চিহ্নিত করতে পারি, এবং তার ভিত্তিতেই নতুন ওষুধ বা চিকিৎসা কৌশল বিকাশ সম্ভব।