মশিউর রহমান
প্রকাশ: ০২ অক্টোবর ২০২৫ | ০৬:৩১ | আপডেট: ০২ অক্টোবর ২০২৫
গত কয়েক বছরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) আমাদের জীবনযাত্রার নানা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। বিনোদন শিল্প, বিশেষত চলচ্চিত্র নির্মাণ এর ব্যতিক্রম নয়। একসময় যা কল্পবিজ্ঞানের বিষয় ছিল, এখন তা বাস্তবে পরিণত হচ্ছে। জেমিনির মতো শক্তিশালী কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলগুলো এখন এমন সব কাজ করতে সক্ষম, যা আগে কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব ছিল। একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র তৈরির প্রতিটি ধাপে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন সহায়তা করতে পারে।
যেমন চলচ্চিত্রের প্রথম পদক্ষেপ হলো চিত্রনাট্য লেখা। কাজটি সৃজনশীল ও সময়সাপেক্ষ। লেখককে প্লট, চরিত্র, সংলাপ এবং দৃশ্যের ধারাবাহিকতা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাজ করতে হয়। জেমিনির মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এই কাজ অনেক সহজ করে দিতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একটি ধারণা দিলে এটি সেই অনুযায়ী একাধিক প্লট আইডিয়া, চরিত্র এবং গল্পের কাঠামো তৈরি করে দিতে পারে। চরিত্রগুলোর ব্যক্তিত্ব এবং দৃশ্যের পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে বাস্তবসম্মত এবং কার্যকর সংলাপ তৈরি করতে পারে। নির্দিষ্ট দৃশ্য বা পরিবেশের বিস্তারিত বিবরণ লিখতে পারে, যা পরিচালক এবং ভিজুয়াল আর্টিস্টদের জন্য সহায়ক। এটি লেখার সময় ভুলত্রুটি এবং অসংগতিও দ্রুত খুঁজে বের করতে পারে।
যেমন চলচ্চিত্রের দৃশ্যমান অংশ তৈরির জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখন অপরিহার্য হাতিয়ার। টেক্সট-টু-ইমেজ মডেল যেমন মিডজার্নি বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে; আর্টিস্ট বা পরিচালক শুধু টেক্সট প্রম্পট দিয়ে চরিত্রের চেহারা, পোশাক এবং দৃশ্যের সেট ডিজাইন তৈরি করতে পারেন। এ মডেলগুলো দিয়ে দ্রুত অসংখ্য বৈচিত্র্যময় ডিজাইন তৈরি করা যায়, যা সময় ও খরচ বাঁচায়। ওপেন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সরা, গুগলের ভিয়ো বা রানওয়ে এমএলের মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা টুল দিয়ে টেক্সট প্রম্পট থেকে সরাসরি ভিডিও ক্লিপ তৈরি করা যায়। একটি সম্পূর্ণ চলচ্চিত্রের প্রতিটি দৃশ্য এভাবে তৈরি করা সম্ভব, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আলো, ক্যামেরা মুভমেন্ট এবং টেক্সচারও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। এটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র তৈরির প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ নতুন স্তরে নিয়ে গেছে।
চলচ্চিত্র সম্পাদনা, স্পেশাল ইফেক্টস এবং সাউন্ড ডিজাইনের মতো পোস্ট-প্রডাকশন কাজও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে দ্রুত ও নিখুঁত করা যায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-চালিত সম্পাদনা টুলগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে অপ্রয়োজনীয় ফুটেজ বাদ দিতে, সেরা শটগুলো বেছে নিতে এবং দৃশ্যগুলোকে মসৃণভাবে সংযুক্ত করতে পারে। গ্রিন স্ক্রিন থেকে অবজেক্ট বা মানুষকে নিখুঁতভাবে আলাদা করা, ব্যাকগ্রাউন্ড পরিবর্তন বা জটিল ভিজুয়াল ইফেক্ট তৈরি এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সহজেই সম্ভব। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দৃশ্যের মেজাজ অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে মিউজিক কম্পোজ করতে পারে। এটি ব্যাকগ্রাউন্ড নয়েজ দূর, সংলাপের ভলিউম নির্ধারণ এবং সাউন্ড ইফেক্ট যুক্ত করতেও সাহায্য করে।
বর্তমানে শুধু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে একটি পূর্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র নির্মাণ এখনও একটি চ্যালেঞ্জ। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যত উন্নতই হোক; মানুষের সৃজনশীলতা, আবেগ এবং মানবিক গল্পের বিকল্প এখনও হয়নি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার তৈরি করা ভিডিও ক্লিপগুলো এখনও ছোট এবং ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন। তাই মানুষের তত্ত্বাবধান ছাড়া একটি অর্থপূর্ণ এবং সুসংবদ্ধ চলচ্চিত্র তৈরি করা প্রায় অসম্ভব। মিডিয়া ও বিনোদন জগতে এআইর বাজার ২০২৪ সালে ২৫.৯৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের সমান মূল্যায়িত। ধারণা করা হচ্ছে, ২০২৫ থেকে ২০৩০ সালের মধ্যে এ খাত প্রতিবছর গড়ে প্রায় ২৪.২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে এবং ২০৩০ সাল নাগাদ বাজারের আকার দাঁড়াবে ৯৯.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চলচ্চিত্র ও বিনোদন শিল্পে যে হারে প্রবেশ করছে, তা একদিকে বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করছে, অন্যদিকে অনেকের মনে উদ্বেগও জাগাচ্ছে।
প্রথমত, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব কাজ বারবার একই ধরনের প্রক্রিয়া অনুসরণ করে– যেমন ভিজুয়াল ইফেক্টসের কিছু অংশ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক তৈরি, ভিডিও এডিটিং বা চিত্রনাট্যের প্রাথমিক খসড়া লেখা। এসব ক্ষেত্রে এআই মানুষের জায়গা নিতে পারে। এর ফলে মডেল, জুনিয়র গ্রাফিক ডিজাইনার, এডিটর কিংবা ছোট বাজেটের প্রডাকশনে কাজ করা শিল্পীরা চাকরির ঝুঁকিতে পড়তে পারেন। দ্বিতীয়ত, এআইর কারণে চলচ্চিত্র নির্মাণের খরচ ও সময় অনেকটা কমে আসবে। এতে নতুন প্রজন্মের নির্মাতা ও স্বাধীন শিল্পীরা সহজে নিজেদের গল্পকে চলচ্চিত্রে রূপ দিতে পারবেন। অন্যদিকে যারা প্রচলিত পদ্ধতিতে কাজ করেন, তাদের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হতে পারে।
তৃতীয়ত, মডেল বা শিল্পীরা পুরোপুরি চাকরি হারাবেন না, তবে কাজের ধরন বদলাবে। যে শিল্পীরা নতুন প্রযুক্তি শিখে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারবেন, তারা আরও চাহিদাসম্পন্ন হবেন। যারা এআইকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহকর্মী হিসেবে দেখবেন, তারাই ভবিষ্যতের বিনোদন শিল্পে এগিয়ে থাকবেন।
বাংলাদেশের সিনেমা নির্মাণে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো অর্থস্বল্পতা। এআই ব্যবহার করে চিত্রনাট্য লেখা, ভিজুয়াল ডিজাইন, অ্যানিমেশন এবং পোস্ট-প্রডাকশনের খরচ অনেকটাই কমানো সম্ভব। ফলে ছোট বাজেটের নির্মাতারা সহজে মানসম্মত কনটেন্ট তৈরি করতে পারবেন। উদাহরণস্বরূপ, ব্যয়বহুল সেট বা বিদেশে লোকেশন শুটিংয়ের পরিবর্তে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে ভার্চুয়াল সেট ডিজাইন করা যাবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বা গান তৈরি এখন সহজ হচ্ছে। এতে তরুণ শিল্পীরা সৃজনশীলভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশি সংগীতশিল্পীদের উদ্বেগ বাড়তে পারে। কারণ প্রযোজকরা কম খরচে এআই মিউজিককে বেছে নিতে পারেন।
অপরদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে বাংলাদেশি নির্মাতারা তুলনামূলক দ্রুত ও কম খরচে আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা তৈরি করতে পারবেন। এতে বিশ্ববাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি হতে পারে। একই সঙ্গে প্রতিযোগিতা বাড়বে। কারণ অন্য দেশ একই প্রযুক্তি ব্যবহার করছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ক্লান্তিকর ও পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো করে দিলে পরিচালক, লেখক এবং শিল্পীরা তাদের সৃজনশীলতার ওপর আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারবেন। ভবিষ্যতে আমরা এমন চলচ্চিত্র দেখতে পাব যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে, কিন্তু গল্পের মূল আবেগ ও নির্দেশনা আসবে মানুষের কাছ থেকে। তাই এআইকে প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোগী হিসেবে ব্যবহার করা শিখতে হবে। শিল্পীরা যদি প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারেন, তবে বাংলাদেশের সিনেমা শিল্প একটি নতুন উত্থানের পথে যেতে পারে।
ড. মশিউর রহমান: ইঞ্জিনিয়ারিং ম্যানেজার, ওমরন হেলথকেয়ার সিঙ্গাপুর [email protected]