লিংক: https://www.facebook.com/share/p/1AKxLYEE1w/

বাল্যকালে, নিউটনের মাথায় আপেল পড়ার মতোই, আমার মস্তিস্কে এক অভূতপূর্ব তত্ত্বের উদয় হলো। আমি তার নাম দিলাম "দণ্ড-পঠন দ্বান্দ্বিকতা" বা ইংরেজিতে যাকে বলে, The Duality of Cane and Canon। তত্ত্বটি অতি সরল: গৃহে দণ্ডের আগমন ও বই পড়ার পরিমাণ পরস্পর ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ, আব্বাজানের করকমলে বেত যত কম শোভা পাবে, আমার জ্ঞানসমুদ্রে অবগাহন তত বাড়বে।

এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের পর, ক্লাস টু-এর আমি নিজেকে প্রায় গ্যালিলিওর সমগোত্রীয় ভাবতে শুরু করলাম। বুঝলাম, সংসারে নির্বিঘ্নে বাঁচতে হলে হয় বীর হতে হয়, নয়তো বিদ্বান হওয়ার ভান করতে হয়। বীর হওয়ার মতো পেশিশক্তি ছিল না, তাই দ্বিতীয় পথটিই বেছে নিলাম। ফলস্বরূপ, আমার পঠন-পাঠনের বহর এমত বাড়িয়া গেল যে, বাড়ির সকলে ভাবিতে লাগিল, এ ছেলে কনিষ্ঠ বিদ্যাসাগর না হইয়া যায় না।

আমার সে সাধনা ছিল এক মহাযজ্ঞ। আব্বাজানের সমক্ষে যখন আমার ভূগোল বই খোলা থাকিত, তিনি কি আর জানিতেন যে, সেই টেক্সটবুক নামক রাষ্ট্রের আশ্রয়ে সেবা প্রকাশনীর মাসুদ রানা নামক এক স্বাধীন প্রজাতন্ত্র দিব্যি চলিতেছে? আমার চোখ তখন সুদূর মিশরের মরুভূমিতে পিরামিডের রহস্যভেদ করিতেছে, আর মুখ হইতে নির্গত হইতেছে, "পদ্মা, মেঘনা, যমুনা—আমাদের তিন প্রধান নদী।" এই যে চক্ষু ও জিহ্বার মধ্যে এক অদ্ভুত কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, যাহাকে ফরাসিতে বলে double entendre, ইহা আমি সেই বয়সেই রপ্ত করিয়াছিলাম। আমার মস্তিষ্ক যেন ছিল এক দুই-ইঞ্জিনবিশিষ্ট বিমান, যার এক ইঞ্জিন চলিত সিলেবাসের পথে, অন্যটি কল্পনার জগতে।

এই সাধনার এমনই তেজ যে, একবার গভীর রাত্রে নিদ্রার ঘোরে শুনিলাম, রান্নাঘরে বিড়াল হাঁড়ি ফেলিয়াছে। আর যায় কোথা! আমার অর্ধচেতন মন ভাবিল, আব্বাজান আকস্মিক পরিদর্শনে আসিয়াছেন। আমি ঘুমের মধ্যেই তারস্বরে হাঁক ছাড়িলাম, "Two ones are two, two twos are four..."। আব্বাজান দেখিয়া ভাবিলেন, ছেলের আত্মা পড়াশোনার চাপে দেহ ছাড়িয়া কেবল বইয়ের জগতে আশ্রয় লইয়াছে। তিনি বিচলিত হইয়া আমাকে এক বিজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন করিলেন।

সেই ডাক্তার ছিলেন এক বিচক্ষণ ব্যক্তি। তিনি আমার নাড়ি টিপিয়া, চক্ষু দেখিয়া, এবং আমার সারাদিনের রোজনামচা শুনিয়া বলিলেন, "ভয়ের কারণ নাই। আপনার পুত্রের কোনো মানসিক বিকার হয় নাই, হইয়াছে 'অতিরিক্ত জ্ঞান-বিকার' । ঔষধ একটাই—প্রত্যহ দুই ঘণ্টা করিয়া টেলিভিশন দর্শন এবং গল্পের বইয়ের সহিত পাঠ্যপুস্তকের বিচ্ছেদ ঘটানো।" আমি তো শুনিয়া আহ্লাদে আটখানা! এ যে স্বয়ং ধন্বন্তরির বিধান!

সেই হইতে আমার পাঠাভ্যাস এক বিচিত্র রূপ লইল। পড়ার নেশাটা রহিয়া গেল, কিন্তু উহার কোনো বাছ-বিচার রহিল না। হাতের কাছে যাহা পাই, তাহাই পড়ি। শৌচালয়ে রাখা হারপিকের বোতলের গায়ে লেখা রাসায়নিক সংকেতগুলি আমার কাছে প্রাচীন মিশরীয় হায়ারোগ্লিফিক বলিয়া মনে হয় এবং উহার ব্যবহারবিধি যেন কোনো পবিত্র ধর্মগ্রন্থের অনুশাসন। সে লেখা আমি এমনই মুখস্থ করিয়াছি যে, প্রয়োজনে হারপিকের গুণাগুণ লইয়া একখানা ক্ষুদ্র পুস্তিকাই লিখিয়া ফেলিতে পারি।

কিন্তু হায়! সকল সাধনারই পতন আছে। আমার এই জ্ঞানতৃষ্ণার সাগর আসিয়া শুকাইয়া গিয়াছে এক মরীচিকার পিছনে, যাহার নাম ফেসবুক। ইহার পাতা উল্টাইতে উল্টাইতে যতই নিম্নে অবতরণ করি, ততই মনে হয়, এ তো পড়া নয়, এ যেন এক অতলান্ত পাতালপুরীর দিকে যাত্রা। নামিতেই থাকি, নামিতেই থাকি। ইহার কি কোনো তল নাই? জানি না, এই নিম্নগামিতাকে অধঃপতন বলা চলে কি না। ফারসি কবি বলিয়াছেন, "হর কস বে-খোদ রফত, উ বে-মঞ্জিল রসিদ" (যে নিজেকে হারাইয়াছে, সে-ই লক্ষ্যে পৌঁছাইয়াছে)। আমি তো ফেসবুকের অতলে নিজেকে হারাইয়াছি, কিন্তু মঞ্জিল কোথায়? সে কথা ভবিষ্যতের গর্ভে। আপনারা ভালো থাকুন। খোদা হাফেজ।

আপাতত, সেই অতলান্ত কূপে ডুবিয়া যাহারা এই রসালো জ্ঞানলিপি পাঠ করিলেন, তাঁহাদের কাছে অনুরোধ, এমন "বৈঠকী কিসসা" - জাতীয় হাস্যরসের স্বাদ পাইতে হইলে আমার পাতাটি লাইক ও সাবস্ক্রাইব করিতে ভুলিবেন না। তাহাতে এই "দণ্ড-পঠন দ্বান্দ্বিকতা" সার্থক হইবে।

আপনারা ভালো থাকুন। খোদা হাফেজ।