‘লং রাজা’ নামে এক জলদস্যু নেতার আস্তানাই ছিল এই দ্বীপে। দূর থেকে নিরীহ দেখালেও, রাতের অন্ধকারে তার দল যেকোনো জাহাজকে গিলে ফেলত।
ফোর্ট সিলোসোর কামানের নলগুলো সেন্তোসা দ্বীপের সামরিক ইতিহাসের নিদর্শনগুলোর মধ্যে অন্যতম।
Published : 27 Sep 2025, 03:53 AM
সিঙ্গাপুরে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করেও, কিছু স্থান যেন বারবার নতুন করে হাতছানি দেয়। এমনই এক জায়গা হলো সেন্তোসা দ্বীপ। এবার ঠিক করলাম, এই দ্বীপের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা গল্পগুলো নতুন করে খুঁজে বের করবো। আমার স্ত্রী মুশফেকা মিতুকে নিয়ে শুরু হলো আমাদের সেন্তোসা যাত্রা।
হারবারফ্রন্ট স্টেশন থেকে যখন সেন্তোসা এক্সপ্রেসে চড়লাম, তখনই বুঝলাম এটা নিছকই এক ট্রেনযাত্রা নয়। মাত্র কয়েক মিনিটের এই ট্রামযাত্রা যেন এক জগৎ থেকে আরেক জগতে পাড়ি দেওয়ার অভিজ্ঞতা। ডানদিকে জানালার ধারে বসে দেখতে পেলাম নীল জলরাশি আর দূরে জেগে থাকা দ্বীপ, যেন হাতছানি দিয়ে বলছে, “এসো, আমি তোমার অপেক্ষায়!” এই যাত্রাপথে অনুভব করলাম, যেন এক সময়চক্র ভেঙে গেছে। আধুনিক কনভেনশন সেন্টার আর পুরনো ব্রিটিশ ব্যারাক ভবন, যা এখন রিসোর্টে রূপান্তরিত, সবই যেন অতীত আর বর্তমানকে এক সুতোয় বেঁধেছে।
সেন্তোসা পৌঁছানোর সঙ্গে সঙ্গেই মনে হলো এক কল্পনার রাজ্যে ঢুকে পড়েছি। যেখানে প্রকৃতি, কল্পনা, ইতিহাস আর ভবিষ্যৎ একসাথে হাত ধরে হাঁটছে। সেন্তোসা নামটি শুনলেই যেন মনে হয় এক নিগূঢ় প্রশান্তি, যার অর্থই শান্তি ও তৃপ্তি। ট্রামে সেন্তোসা পৌঁছেই আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল এর সমুদ্র সৈকত। পালাওয়ান, সিলোসো ও তানজং—এই তিনটি সৈকতের প্রতিটিই যেন তিনটি ভিন্ন চরিত্র। পালাওয়ান সৈকত শিশুদের মতো রঙিন আর প্রাণবন্ত, সিলোসো সৈকত যুবকদের কোলাহলপূর্ণ বিনোদন আর স্পোর্টস অ্যাক্টিভিটির কেন্দ্র, আর তানজং সৈকত প্রেমিক, কবি ও নীরব দর্শকদের জন্য এক নির্জন আশ্রয়।
আজকের ব্যস্ত সেন্তোসার পেছনে লুকিয়ে আছে এক বিস্ময়কর সময়ের গল্প। চলুন, চোখ বন্ধ করে আমরা দু’হাজার বছর পেছনে ফিরে যাই। আজকের সেন্তোসার জায়গায় একসময় ছিল জঙ্গলে ঘেরা, ধূসর পাথরের উপত্যকায় মোড়া একটি ছোট দ্বীপ। তখন এর নাম ছিল ‘পুলাউ ব্লাঙ্গাহ’, অর্থাৎ ‘পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত দ্বীপ’।
ঘন সবুজ বৃক্ষরাজিতে ঢাকা, কাঁকড়া আর কচ্ছপের ঘ্রাণে ভরা এখানকার বাতাস। কথিত আছে, রাতের বেলায় এই দ্বীপে নাকি আত্মাদের নাচ দেখা যেত। কেউ কেউ বলেন, এখানেই ছিল এক সন্ন্যাসীর আশ্রম, যিনি বছরের পর বছর ধরে যোগাসনে বসে সমুদ্রের গর্জন শুনতেন। আরও প্রাচীনকালে, চোল সাম্রাজ্যের নাবিকরা এই দ্বীপটিকে জলপথের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করতেন।
সতেরো শতকে এই দ্বীপটি হয়ে ওঠে এক ভয়ের নাম। জলদস্যুরা এখানেই তাদের ঘাঁটি গড়েছিল। ‘লং রাজা’ নামে এক জলদস্যু নেতার আস্তানাই ছিল এই দ্বীপে। দূর থেকে নিরীহ দেখালেও, রাতের অন্ধকারে তার দল যেকোনো জাহাজকে গিলে ফেলত। তখন এটিকে বলা হতো ‘পুলাউ ব্লাকাং মাটি’ বা পেছনের দিকে মৃত্যুর দ্বীপ। মৃত্যুর ভয় থাকা সত্ত্বেও বণিকরা আসত, কারণ এই দ্বীপ থেকে চীন, মালাক্কা ও ইন্দোনেশিয়ার মধ্যে নৌপথ ছিল সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত। লবণ, সুগন্ধি, রত্ন আর দাস; সবকিছুরই লেনদেন চলত এখানে।
এ সময়ে স্থানীয় মালয় জনজাতিরা দ্বীপে মাছ ধরা, নারকেল তেল বানানো আর সিপাহি জোগাড়ের কাজ করত। পরবর্তীতে তাদের নিয়েই তৈরি হয়েছিল এক প্রাচীন গোষ্ঠী ‘ওরাং লাউত’, যারা শুধু সমুদ্রেই বাস করত। তাদের কথায়, “আমরা সমুদ্রের সন্তান। দ্বীপ আমাদের মা।”
১৮১৯ সালে স্যার স্ট্যামফোর্ড র্যাফলস যখন সিঙ্গাপুরে ব্রিটিশ পতাকা স্থাপন করেন, তখন তার দৃষ্টিগোচর হয় এই কৌশলগত অবস্থানের দ্বীপ ‘পুলাউ ব্লাঙ্গাহ’। মূল ভূখণ্ডের কাছাকাছি, আবার দক্ষিণে মালাক্কা প্রণালির দ্বাররক্ষক। ব্রিটিশরা দ্বীপটিকে সামরিক ঘাঁটিতে পরিণত করে। ১৮৮০-এর দশকে নির্মিত হয় ফোর্ট সিলোসো ‘সাইলেন্ট ফোর্ট’। বলা হয়, এই দুর্গের দেওয়ালে কান পাতলে আজও নাকি শোনা যায় কামানের গর্জন আর প্রাচীন ব্রিটিশ সৈনিকদের পদচিহ্ন।
ফোর্ট সিলোসো শুধু কামান আর কাঁটাতারের নয়, বরং এক আবেগঘন কাহিনির ধারক। এখানে পোস্টেড ছিলেন ক্যাপ্টেন হাওয়ার্ড মিলস, এক যুবক অফিসার, যার লেখা চিঠিগুলো এখনও সংরক্ষিত আছে একটি অপ্রকাশিত স্মৃতিকথায়। তিনি এক চিঠিতে লেখেন, “প্রিয় মেরি, এই দ্বীপে প্রতিদিন সূর্যাস্ত যেন রক্তের মতো লাল। আমরা কাঁটাতারের আড়াল থেকে সমুদ্র দেখি, আর ভাবি, যদি যুদ্ধ আসে, এই ঢেউই কি আমাদের গোর হবে?” ক্যাপ্টেন মিলস আর কখনও ফিরে যাননি ইংল্যান্ডে।
ফোর্ট সিলোসোর ভেতরের একটি প্রদর্শনী, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সৈন্যদের এক বাঙ্কারে গোলাবারুদ বহন ও লোড করতে দেখা যাচ্ছে।
১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াল ছায়া পড়ে সিঙ্গাপুরের ওপর। জাপানি বাহিনী প্রবেশ করে শহরে, আর ব্রিটিশরা আত্মসমর্পণ করে। সেন্তোসার ফোর্ট সিলোসো ছিল দক্ষিণের শেষ প্রতিরক্ষা। কিন্তু সেই কামানগুলো স্থাপন করা হয়েছিল কেবল সমুদ্র থেকে আসা আক্রমণের প্রতিরোধে। জাপানিরা এসেছিল উত্তর দিক থেকে, ফলে অস্ত্রবাহী ফোর্ট সিলোসো দাঁড়িয়ে থাকল। নির্বাক, অকার্যকর।
এ সময়ে জাপানিরা দ্বীপটিকে যুদ্ধবন্দিদের বন্দিশিবিরে পরিণত করে। বহু অস্ট্রেলীয়, ব্রিটিশ ও স্থানীয় বন্দী এখানে নির্যাতনের শিকার হন। আজও কেউ কেউ বলেন, রাতে ফোর্টের পুরনো সুড়ঙ্গ থেকে কান্নার শব্দ শোনা যায়। আজ ফোর্ট সিলোসো একটি জাদুঘর, তবু ইতিহাসের ভার যেন এখনও দেওয়ালে জমা আছে।
১৯৬৫ সালে সিঙ্গাপুর স্বাধীনতা লাভ করার পর সরকার নতুন এক পরিকল্পনা নেয়, এই দ্বীপটিকে একটি শান্তির স্থান হিসেবে গড়ে তোলার। ১৯৭২ সালে সরকারিভাবে নাম পরিবর্তন করা হয়: পুলাউ ব্লাঙ্গাহ হয়ে ওঠে ‘সেন্তোসা’, যার অর্থ ‘শান্তি ও প্রশান্তি’। সেই ধারণা থেকেই গড়ে ওঠে হোটেল, সৈকত, চিড়িয়াখানা আর পরবর্তীতে ইউনিভার্সাল স্টুডিওস। ১৯৮০-এর দশকে এখানে চালু হয় মনোরেল, কেবল কার আর রাতের লাইট শো।
অনেক যুগ আগে, সেন্তোসার সৈকত ছিল এক প্রাকৃতিক স্বর্গ। সে সময় এই অঞ্চলের সমুদ্রের গভীরে বাস করত এক সুন্দর সমুদ্রকন্যা, যার নাম ছিল তাসমিনা। তার সুরেলা কণ্ঠে গাওয়া গান শুনলে সমুদ্রের ঢেউও থেমে যেত। কিন্তু একদিন, দূর থেকে এক বাণিজ্যিক জাহাজ এসে পৌঁছাল সেন্তোসার তীরে। জাহাজের কনকনে শব্দ আর সীমাহীন বাণিজ্যিকতা সমুদ্রের শাশ্বত শান্তিকে এক অনিশ্চিত পরিণতির দিকে ঠেলে দিল।
যখন সেন্তোসা দ্বীপে ব্যবসায়ীদের আনাগোনা বাড়তে থাকে, তখন একসময় এখানে জলদস্যুরা গড়ে তোলে তাদের গোপন ঘাঁটি। এক জলদস্যু প্রধান, লং রাজা, দ্বীপের শান্তি পছন্দ করত না। তার দলের সদস্যরা একদিন সমুদ্রের গহিনে তাসমিনার বাসস্থান খুঁজে পায় এবং তাকে অপহরণ করে। তাসমিনা, যখন তাদের হাতে বন্দী হয়ে পড়ে, তখন সে নিজের রাজত্ব রক্ষা করতে গিয়ে অভিশাপ দেয়, “যতক্ষণ না তোমরা প্রকৃত শান্তি বুঝতে পারবে, ততক্ষণ এই দ্বীপের জল আর সমুদ্র তোমাদের প্রেরণা দেবে না। তোমরা হবে সাপ, যারা সারাজীবন এই দ্বীপে ঘুরে বেড়াবে।”