১৮৮২ সালের এক দুপুরে ঘোড়া খুঁজতে গিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলেন অভিবাসী টম উইলসন।
‘এমেরাল্ড হ্রদ’ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ইউহো ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত, যা লেইক লুইস থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার পশ্চিমে। ছবি: লেখক
ভাবুন, আপনি একটি টাইম মেশিনে উঠেছেন। আপনাদের নিয়ে যেতে চাই অতীতের কোন একটি সময়ে, একটু পেছনের দিকে উনিশ শতাব্দীর মাঝামাঝি। যুক্তরাজ্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কলোনি গড়ে তুলছিল। কিন্তু তাদের নিজের দেশে শিল্পবিপ্লবের কারণে জীবনযাত্রার খরচ অনেক বেড়ে যাচ্ছিল। সেই সময়টিতে অনেক অভিবাসী নতুন জীবনের আশায় যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন কলোনি দেশগুলোতে পাড়ি দিচ্ছিল। সেই দলের একটি অংশ কানাডা পাড়ি দেয় আর সেই সময়টিতে আমরা টাইম মেশিনে হাজির হলাম ১৮৪০-এর দিকে।
সেই পাড়ি দেওয়া অভিবাসী দলে ছিলেন জন উইলসন ও তার পরিবার। প্রাথমিকভাবে উইলসন অন্টারিওতে বসবাস করে সেখানে কাজ করতে শুরু করেন। কিন্তু নতুন দেশে জায়গা করে নেওয়ার জন্য তাকে অনেক পরিশ্রম করতে হয়েছিল। ১৮৫৯ সালে তার স্ত্রীর কোলে নতুন সন্তান আসে। তাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন দেখে বাবা নাম রাখেন টম উইলসন। আমাদের গল্পের নায়ক এই টম।
ছেলেবেলা থেকেই পাহাড় পর্বতকে খুব ভালোবাসতেন টম। আদিবাসী ও প্রকৃতির প্রতি ছিল এক গভীর ভালোবাসা। টম পড়াশোনা শেষ করে আমেরিকার কিছু পাহাড় ঘুরে বেড়ান। সেখানে থেকে পরে কানাডার প্যাসিফিক রেলেওয়ে প্রতিষ্ঠানে চাকরি পান। বাবা অনেক গর্ব বোধ করে তার সন্তানকে নিয়ে। অন্তত নতুন একটি দেশে ভালো একটি চাকরি। কিন্তু বাবা তখনও জানতেন না যে তার এই টম একদিন ইতিহাসে জায়গা করে নেবে।
টম রেল কোম্পানিতে সার্ভেয়ার হিসেবে কাজ করতেন। ছবি: উইকিপিডিয়া
টম রেল কোম্পানিতে সার্ভেয়ার হিসেবে কাজ করতেন। নতুন রেলের রাস্তা কোথায় বানানো যায়, কোথায় পাহাড় পর্বত রয়েছে, ইত্যাদি খুঁটিনাটি ম্যাপ তৈরি করতে। তার আদিবাসী গাইডের সাথে বেড়িয়ে পড়েন ক্যালগেরি এবং ব্রিটিশ কলম্বিয়ার পাহাড় পর্বতে। যেখানে যান সার্ভে করে ডকুমেন্ট করতে থাকেন সেই জায়গাগুলোর কথা। এই জায়গাগুলোতে কানাডার আদিবাসীরাও খুব কমই যেত।
কিন্তু নতুন নতুন জায়গা ভ্রমণ করার নেশা তাকে নিয়ে যায় প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এমন সব জায়গায় আদিবাসী ছাড়া সাধারণ মানুষের পা কখনও পড়েনি। তাই কোন তথ্য নেই সেই জায়গাগুলো সম্বন্ধে। কিন্তু আমাদের টম লিখে চলছেন তার নোট খাতায় এই জায়গাগুলোর কথা।
১৮৮২ সালের কোন একটি দিনের কথা। ভ্রমণ করতে করতে টম হঠাৎ খেয়াল করেন তার কিছু ঘোড়া হারিয়ে গেছে। সেই ঘোড়াগুলো খুঁজতে গিয়ে তিনি একটি অপূর্ব সুন্দর হ্রদের সামনে এসে হাজির হন। এক ভীষণ রকমের ভালোলাগায় মনটা তার ভরে উঠে। হ্রদের পানির দিকে তাকিয়ে তার সুন্দর এমেরাল্ড রত্নের সবুজ রঙের সাথে তিনি অদ্ভুত মিল পান। এমেরাল্ডকে বাংলায় আমরা বলি ‘পান্না’। সেই পান্না রঙের সাথে নাম মিলিয়ে তিনি নোটবুকে এই হ্রদটিকে ‘এমেরাল্ড লেইক’ নামেই ডাইরিতে লিপিবদ্ধ করেন।
হ্রদের সামনে এসে সেই টম সাহেবের মত আমারও চোখদুটি ছানাবড়া হয়ে গেল। ছবি: লেখক
আরেকটি সূত্র বলছে, টমাস এডমন্ডস উইলসন ১৮৮২ সালে কানাডার রকি পর্বতমালায় রেলপথ নির্মাণের সময় আদিবাসী গাইড এডউইন হান্টারের সহায়তায় এমেরাল্ড হ্রদে পৌঁছান। হ্রদের পান্না সবুজ রঙ দেখে তিনি এর নাম দেন ‘এমেরাল্ড লেইক’। পরবর্তীতে সেই এমেরাল্ড নামেই এই হ্রদটির নামকরণ করা হয়। এর পরে অনেকেই সেই হ্রদে এসে পান্নার রং দেখে মুগ্ধ হয়েছে। তবে প্রাচীন কালে এখানে যেতে হলে ঘোড়া দিয়েই যেতে হত।
এই আবিষ্কারের পর প্রায় দেড়শ বছর পার হয়ে গেছে। এই গল্পের লেখক প্রাচীনকালের ঘোড়া নয়, সুন্দর চকচকে রাস্তা দিয়ে শেভরোলেট পিকআপ দিয়ে আমরা পৌঁছে গেলাম এই হ্রদে। আমার কানাডা ভ্রমণের এই অংশে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ইয়োহো জাতীয় পার্কের এই এমেরাল্ড হ্রদের গল্পই আপনাদেরকে বলছি। এমেরাল্ড হ্রদ ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ইউহো ন্যাশনাল পার্কে অবস্থিত, যা লেইক লুইস থেকে প্রায় ৩৯ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত।
হ্রদের সামনে এসে সেই টম সাহেবের মত আমারও চোখদুটি ছানাবড়া হয়ে গেল। ভ্রমণের ক্লান্তি মুহূর্তেই দূর হয়ে গেল, থমকে দাঁড়িয়ে গেলাম। প্রকৃতি দেখতে সুন্দর এবং সেই সুন্দর প্রকৃতি দেখার তাড়নায় যাযাবরের মতন কত দেশ ঘুরে বেড়িয়েছি, তার কোন ইয়ত্তা নেই। কিন্তু এই এমেরাল্ড হ্রদে এসে আসলেই হতবিহ্বল হয়ে গেলাম।
হ্রদের পাড়ে লেখক ও তার স্ত্রী মুশফেকা মিতু।
আকাশ এবং হ্রদের শৈবালের রঙে পান্নার মতনই নীলচে সবুজ রং নিজের মধ্যে ধারণ করেছে। পানির নিজস্ব রং নেই, সে অন্যের রঙে নিজেকে সাজাতে পছন্দ করে। মনে পড়লো রবি ঠাকুরের সেই ‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ’ কবিতাটি। তিনি এই জায়গাটিতে এলে নিশ্চয় অন্যকোনোভাবে এই হ্রদটি নিয়ে কবিতা লিখতেন।
ক্যালগেরিতে আমাদের হোস্ট হলেন অতনু আপা, যিনি আমার গিন্নী মিতুর বড় বোন। এমেরাল্ড হ্রদে পৌঁছার সাথে সাথেই তিনি দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে দিলেন। দীর্ঘদিন ধরেই তিনি কানাডাতে বসবাস করেন বলেই হয়ত, একেবারেই করিতকর্মা। আমার এক সিনিয়র ভাই বলেছিলেন যে প্রবাসে আসার পর সবার নাকি আলাদা করে দুটি হাত গজিয়ে যায়। আমার এই আপারও মনে হয় চারটা হাত।
আমাদের একটি টেবিলে বসতে বলে গাড়ি থেকে জিনিসপত্র নিয়ে চলে আসলেন। আমি একটু পরে এসে দেখি পুরো টেবিল সাজিয়ে ফেলেছেন খাবারে। টেবিল ক্লথ দিয়ে পরিপাটি করে সাজান আছে সব ধরনের খাবার। প্রবাসে যারা থাকেন তাদের যেহেতু নিজের হাতেই কাজ করতে হয়, তাই সাধারণত তারা বিভিন্ন কাজে পারদর্শী হয়ে যান। সেটা মনে হয় জীবনের প্রয়োজনেই। বাচ্চারা গোগ্রাসে সব চেটেপুটে শেষ করে ফেললো সব খাবার।
খাবার সেরে আমরা হ্রদের চারদিকে হাঁটতে বের হলাম। এই হ্রদের পাশে ছোট ছোট কটেজ বা লজিং বাসা রয়েছে যেখানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে প্রতিদিনের ভাড়ার জন্য খরচ করতে হবে ৮০০ ডলার বা প্রায় ৮০ হাজার টাকা। তবে তা মৌসুম ও কক্ষের ধরন অনুযায়ী পরিবর্তিত হতে পারে। টাকারও অঙ্কটা শুনে ভড়কে গেলাম। তবে মনে হলো, একবার থাকলে মন্দ হয় না। এমন সুন্দর জায়গায় রাত কাটানো নিশ্চয় একটু বিরল অভিজ্ঞতা হবে।
হাঁটতে হাঁটতে এমেরাল্ড হ্রদটিকে যখন একেক জায়গা থেকে দেখছি, তখন তাকে একেক রঙের বলে মনে হচ্ছে। ছবি: লেখক
হাঁটতে হাঁটতে এমেরাল্ড হ্রদটিকে যখন একেক জায়গা থেকে দেখছি, তখন তাকে একেক রঙের বলে মনে হচ্ছে। কোথায় মনে হল নীল, কিন্তু আরেকটু এগিয়ে যাবার পরে দেখি হালকা সবুজের আভা তাতে দেখা যাচ্ছে। গোধূলিতে যেমন পশ্চিম আকাশের রংকে ধরা যায় না, মুহূর্তের মধ্যেই তার রং পরিবর্তন করে, এই হ্রদটাও দেখছি তাই। একেক দিক থেকে একেক রঙে সাজিয়ে যেন আমার কাছে ধরা দিচ্ছে। কেমন যেন একটা লুকোচুরি খেলছে আমার সাথে। ছেলেবেলার লুকোচুরি খেলার শিহরন যেন বয়ে গেল আমার শিরদাঁড়া দিয়ে।