লিংক: https://samakal.com/opinion/article/311894/শিক্ষায়-মৌলিক-সংস্কার-যে-কারণে-জরুরি
প্রকাশ: ২৩ আগস্ট ২০২৫ | ০০:০৮
বিদেশে মেধাবীদের চলে যাওয়া, দেশের প্রতিভাশালী তরুণদের হারানো নিয়ে হাহাকার শোনা যায় বাংলাদেশের সবখানে। সংবাদপত্র, টকশো ও সামাজিক মাধ্যমে এ অভিযোগ প্রায়ই পা যায়, বিদেশে চলে যাওয়া তরুণরা দেশের ক্ষতি করছে। কিন্তু আমরা প্রায়ই ভুলে যাই, দেশের ভেতরেই আরেকটি গভীর সংকট নীরবে বেড়ে চলেছে। এটি হলো ‘ব্রেইন ওয়েস্ট’ বা মেধার অপচয়। অর্থাৎ যে তরুণরা বিদেশে যাচ্ছে না, দেশেও তাদের প্রতিভা কোনো কাজে লাগছে না।
একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী কল্পনা করে, ডিগ্রি শেষ করলেই তার শেখা জ্ঞান দিয়ে সমাজে পরিবর্তন আনা যাবে। তার চোখে তখন অনেক স্বপ্ন– কম খরচে নতুন সেমিকন্ডাক্টর তৈরি, পরিবেশবান্ধব শক্তি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধান কিংবা জটিল রোগের ওষুধ সরবরাহে অভিনব প্রযুক্তি উদ্ভাবন অথবা সফটওয়্যার তৈরি করে আমাদের সমস্যার সমাধান করবে। বাস্তবে দেখতে পায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখা অনেক কিছুই ব্যবহারের অযোগ্য। তাকে শেখানো হয়েছে কার্নো হিট ইঞ্জিনের কার্যকারিতা। বাস্তবে এমন ইঞ্জিন নেই। তাকে বোঝানো হয়েছে জটিল সমীকরণ। কিন্তু সমাজের সমস্যাগুলো সমাধানে সেই সমীকরণের প্রয়োগ কোথায়– তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। দেশে এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই, যেখানে তার শেখা কিংবা গবেষণার ফল কাজে লাগতে পারে।
শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো গবেষণা করে না। প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নতুন উদ্ভাবনের পরিবর্তে পুরোনো জিনিস চালিয়ে যেতে চায়। ফলে তরুণকে মূল্যায়ন করা হয় একেবারে ভিন্ন মানদণ্ডে– সে কতটা সাবলীল ইংরেজি বলতে পারে, কতটা চটকদার পাওয়ারপয়েন্ট বানাতে জানে কিংবা কত সহজে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করতে পারে।
আমরা এখনও এমন একটি কাঠামোতে আটকে আছি, যেখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে পরীক্ষায় ভালো নম্বর তোলা, মুখস্থ বিদ্যায় ডিগ্রি অর্জন। বাস্তব সমস্যা সমাধান বা শিল্পক্ষেত্রে প্রয়োগযোগ্য জ্ঞান অর্জনের সুযোগ নেই বললেই চলে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা প্রচুর সময়, শ্রম আর অর্থ ব্যয় করে এমন সব জ্ঞান অর্জন করছে, যার বাজারে কোনো প্রয়োজন নেই।
এই পরিস্থিতির সঙ্গে জুড়ে গেছে আরেকটি বিষয়। সরকারি চাকরির স্বপ্ন অনেক তরুণকে বছরের পর বছর অলস অপেক্ষায় বন্দি করে রাখছে। তারা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে, আবেদন করছে, পরীক্ষার তারিখের জন্য অপেক্ষা করছে, তারপর আবার ফলের জন্য অপেক্ষা। একেকটি ধাপ পার হতে কেটে যাচ্ছে বছর, অথচ কোনো নিশ্চয়তা নেই। ফলস্বরূপ একটি প্রজন্মের সবচেয়ে কর্মক্ষম সময় চলে যাচ্ছে শুধু অপেক্ষার গহ্বরে। প্রশ্ন হলো, যেখানে তরুণরা শুধু দৌড়ঝাঁপ করবে, অথচ বাস্তবে তাদের শ্রমের কোনো ফল আসবে না, সেখানে আশা বাঁচবে কীভাবে?
আমরা যখন ব্রেইন ড্রেনের কথা বলি, তখন অন্তত ধরে নেওয়া যায়, বিদেশে গিয়ে একজন তরুণ তার প্রতিভাকে কাজে লাগাচ্ছে। হয়তো সে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করছে; বিশ্বমানের গবেষণায় অবদান রাখছে। যদিও দেশ তার মেধা হারাচ্ছে, কিন্তু পৃথিবী অন্তত সেই প্রতিভার সুফল পাচ্ছে। কিন্তু ব্রেইন ওয়েস্টের ক্ষেত্রে ক্ষতি সবার। দেশের ভেতরে থেকে প্রতিভা নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু তার কোনো কার্যকর ফল সমাজ পাচ্ছে না।
এটি শুধু ব্যক্তিগত সমস্যা নয়, জাতীয় সংকট। কারণ একটি দেশের উন্নতির মূল চালিকাশক্তি তরুণ প্রজন্ম। তাদের জ্ঞান, সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনই হতে পারে অর্থনীতি ও সমাজের নতুন ভিত্তি। যদি সেই মেধার প্রতিনিয়ত অপচয় হয়, তবে রাষ্ট্রের উন্নয়ন থমকে যাবে।
বৈশ্বিক পরিসংখ্যান দেখলে স্পষ্ট হবে কতটা পিছিয়ে আছি আমরা। ভারতের অনেক তরুণ স্টার্টআপ শুরু করছে, যেগুলো বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করছে। ভিয়েতনামের শিক্ষার্থীরা প্রযুক্তি খাতে নিজেদের প্রমাণ করছে, নতুন নতুন উদ্ভাবনে বিনিয়োগ পাচ্ছে। এমনকি আফ্রিকার রুয়ান্ডার মতো দেশও এখন প্রযুক্তিনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তুলছে। অথচ বাংলাদেশে একই সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও তা কাজে লাগাতে পারছি না।