প্রবাস মানেই ঝলমলে জীবন, বিদেশী মুদ্রার ঝনঝনানি আর সাফল্যের উজ্জ্বল মেডেল—এই ধারণাটা আমাদের সমাজে বেশ গভীরভাবে গেঁথে আছে। কিন্তু প্রবাসে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকে আমি বুঝেছি, এই ধারণা একেবারেই ভুল। প্রতিটি প্রবাসীর হৃদয়ই আসলে এক কান্না ভরা সাগর। বাইরে থেকে যে জীবনটা রঙিন বলে মনে হলেও, ভেতরে দেখতে পাবেন এক অদৃশ্য দেয়ালবিহীন কারাগার।

বিদেশের আলো ঝলমলে শহরগুলোতে হাঁটলে কিংবা সোশ্যাল মিডিয়াতে তাদের পোস্টগুলি দেখে মনে হতে পারে, প্রবাসীরা বড় সুখে আছে। কিন্তু তাদের ভেতরের মানসিক যুদ্ধের কোনো শব্দ নেই, কোনো দাগ নেই, নেই দৃশ্যমান আঘাতও। অথচ এই নীরব যুদ্ধই প্রতিদিন প্রবাসীর মনকে ক্ষতবিক্ষত করে।

প্রবাসীর জীবনে সবচেয়ে বড় বেদনা হলো আপনজনকে না পাওয়ার হাহাকার। বাবা সন্তানের প্রথম হাঁটা কিংবা স্কুলে ভর্তি হওয়ার দিনটিতে থাকতে পারেন না, মা সন্তানের প্রথম শব্দ শোনার আনন্দ পান না। স্বামী-স্ত্রী টেলিফোনের ওপার থেকে ভালোবাসা ও দায়িত্বের বাঁধন ধরে রাখেন, অথচ স্পর্শের উষ্ণতা থাকে না। দেশের মাটিতে রেখে আসা মা-বাবা, ভাই-বোনদের জন্য মন কাঁদে। ঈদ, পূজা কিংবা নববর্ষের দিনে যখন দেশে উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে, প্রবাসীর ঘরে তখন নীরব দীর্ঘশ্বাসই একমাত্র সঙ্গী।

জাপানে ঈদের দিনে আমার ফোনটি নিয়ে সেই প্রবাসী বড় ভাইটি তার স্ত্রীকে বলেছিলেন, “আমি ভালো আছি”—কিন্তু ফোন কেটে দিয়ে তিনি নিঃশব্দে দাড়িয়ে অনেকক্ষণ কেঁদেছিলেন। আমি পাশে দাড়িয়ে তার ঘাড়ে হাত রেখে সহানুভূতির কিছুই বলতে পারিনি। ভাষা সেদিন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাশের সমুদ্রের শীতল বাতাস তার হৃদয়কে শান্ত করতে পারেনি।

হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে উপার্জিত টাকা দেশে পাঠানো হয় আপনজনের সুখের জন্য। কিন্তু সেই অর্থ ভুল খাতে ব্যয় হলে, কিংবা প্রিয়জনেরাই প্রতারণা করলে প্রবাসীর আঘাত অসহনীয় হয়ে ওঠে। কত প্রবাসীই নিজের জীবনের সঞ্চয় হারিয়ে ফেলেছেন অবিশ্বাসের ছুরিতে। মালেশিয়াতে শপিং মলের সিড়ির এক কোনাতে এক বাংলাদেশী ভাই অশ্রু ফেলছিলেন। আমি তার কাছে গেলে, তিনি বললেন, “কার জন্য এত কষ্ট, কার জন্য এত বিসর্জন?”। পরে জানতে পারলাম তার স্ত্রী ঘরের সন্তানটিকে রেখে প্রাক্তন প্রেমিককে নিয়ে পালিয়ে গেছে।

আমরা যাদের দেখি বিদেশী নাগরিকত্ব নিয়ে অট্টালিকায় বাস করতে, বিলাসবহুল গাড়ি চালাতে, তাদের জীবনকেও মনে হয় নিখুঁত। কিন্তু আমেরিকার সেই সফল প্রবাসী বন্ধুটিও একদিন ড্রাইভ করতে করতে হটাৎ রাস্তায় দাড়ি থাকিয়ে আমাকে বলেছিল, “দোস্ত, আর ভালো লাগে না।” কারণ অর্থে প্রাচুর্য থাকলেও হৃদয়ের একাকীত্ব মেটে না। নিজের ভাষায় কথা বলার সুযোগ না থাকলে, সংস্কৃতির টান না থাকলে, সব সফলতাই মায়া হয়ে যায়।

আমরা প্রবাসীদের দেখি রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসেবে। বাহবা দিই, তাদের পাঠানো অর্থ দিয়ে দেশ চলে। কিন্তু তাদের নোনাজল, তাদের নিঃশব্দ আত্মত্যাগ আমরা কতটা দেখি? প্রবাস জীবন আসলে নিজেকে বিলিয়ে দিয়ে অন্যকে ভালো রাখার প্রচেষ্টা।

প্রবাসীর চোখের জল যেন কেবল স্মৃতির আড়ালে হারিয়ে না যায়। তারা যেন টাকার মেশিন নয়, মানুষ হিসেবে মূল্যায়িত হন। তাদের এই কান্না ভরা সাগর শুকিয়ে আবার হাসির ঢেউ তুলতে পারাটাই আমাদের দায়িত্ব।