আমরা বাংলাদেশিরা যে একটু বেশীই মাত্রায় পরিবার কেন্দ্রিক হই তাহা বলিবার অবকাশ নাই। আমাদের জীবন জগত সবই পরিবারকে কেন্দ্র করিয়া লালিত হয়। আর সেইজন্যে আমরা দেখতে পাই যে, কেহ যখন গ্রামীন পরিবেশ থেকে জীবিকার তাড়নায় ঢাকায় আসিয়া বসবাস শুরু করিয়া থাকেন, তখনই তাহারা ভীষণ রকমের হোমসিক হইয়া পড়িয়া যান। তাহাদের বাসা ভাড়া কিংবা খাবারের কষ্টের থেকেও বড় কষ্ট হইলো- বাড়ির জন্যে মন খারাপের কষ্ট। আর সেইজন্যে আমরা দেখি কি ঘটা করিয়া তাহারা ঈদে কিংবা অন্য কোন প্রকার সুযোগ পাইলেই গ্রামের বাড়ির দিকে রওনা হইয়া যান।
যাযাবারের মতন অনেক দেশে বসবাস করিয়া এই লেখকের অনেক দেশ দেখিবার সুযোগ হইল এবং অনেক জাতির লোকজনের সাথেই মেলামেশা করিবার সুযোগ হইলো, কিন্তু এইভাবে “বাড়ির জন্য মন কাঁদে” জাতীয় কথাবার্তা খুব একটা শোনা হইনাই।
হোমসিক শব্দটির বাংলা শব্দ কি হইতে পারে?- সেইটা জানিবার জন্যে অভিধানখানি টানিয়া লইয়া দেখিলাম - কি আশ্চর্য! বাংলা ভাষাতে সেটিরও নিজস্ব কোনো শব্দ নাই। যাহা পাইলাম তাহা হইল নিম্নের অর্থগুলো,
হোমসিক: পারিবারিক উদ্বেগ, স্বদেশ ভেবে অবসন্ন, ঘরকাতুরে, স্বদেশের জন্য মন কাঁদে, শোকাহত, গৃহহীন, ঘরকাতুরে।
অর্থাৎ বাংলা ভাষা জন্মের শুরুর কিংবা প্রাথমিক সময়ে, বাংলাদেশি কিংবা বাঙালিদের এই শব্দটির প্রয়োজন হয় নাই। সময়ের প্রয়োজনে এই শব্দটির ব্যবহার প্রয়োজন হইলে, তাহারা কিছু অর্থ বা ব্যাখ্যা খুঁজে নিয়েছে মাত্র। প্রয়োজন হইলে- নিশ্চয় সেইটির একটি নিজস্ব শব্দ আমাদের অভিধানে থাকিত। যেইভাবে জাপানিজ অভিধানে “রোমান্টিক” শব্দটির জন্য জাপানিজভাষাতে নিজম্ব কোন জাপানিজ শব্দ নাই। তাহারা কাতাকানা (KATAKANA) বা বিদেশী শব্দ লইয়া সেই ভাবটি প্রকাশ করিয়া থাকে।
যে “হোমসিক” শব্দটি লইয়া এই লেখক বিশাল ক্যাচাল করিতেছেন, সেইটির সাথে লেখকের প্রথম পরিচয় ঘটিয়াছিল সেই কৈশরে। পাঠক মহাশয়দের ধৈর্যচ্যুতি না ঘটলে, একটু সময় দিলে স্ববিস্তারে তা বলিবার সাহস করি।
লেখক বড় হইয়াছেন ঢাকার মোহাম্মদপুরে। কৈশরে পা দিইয়াছেন এবং পাড়ার পোলাপাইনদের সাথে সাত-চারা খেলিয়া সময় পার করিতেছেন। সেই সময়ে তার বাবা ১৭ এপ্রিল ১৯৮৭ তারিখে রাজশাহী ক্যাডেট কলেজে ভর্তি করিয়া দিয়ে ফিরিয়া গেলেন। সেইদিন রাতেই লেখক প্রথম এই শব্দটির মুখোমুখি হইলেন।
এই শব্দটির কষ্ট, দুঃখবোধ এবং যাতনাটি তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করিতে পারিলেন। শব্দ তো অভিধানে লিখা থাকে, তা উঠে এসে আমাদেরকে উচ্চবাচ্য করেনা। কিন্তু তার উপলব্দিটা আমাদের অন্যভাবে বুঝিয়ে দিইয়া ছাড়ে। ঢাকার সেই গৃহ, আর তার মাতৃমহের হাতের লোভনীয় খাবার - লেখককে চুম্বকের মতন হাজার মাইল দুর থেকেও ডাকা শুরু করিয়া দিল। সেই ডাক অগ্রাহ্য করার উপায় সৃষ্টিকর্তা তাকে দেন নাই। ভীষণ মানসিক কষ্টে তার চোখ দিয়ে পানি আসা শুরু করলো। পাশ ফিরেই লেখক দেখিলেন তারই সতির্থ সাইফ তিনিও কাঁদিতেছেন।
কলেজে যাবার আগে অনেকেই লেখককে বলিয়াছিলেন যে, হোস্টেলে যাইয়া তোমার অনেক মন খারাপ করিবে। সেই মনখারাপ মানে যে “হোমসিক” তা লেখক বুঝিতে পারিলেন সেই রাতে। তবে প্রবাহমান সময়ের সাথে সাথে- সেই কৌশরেই লেখক হোমসিক-কে মোকাবেলা করার কৌশলগুলো শিখে গেলেন। ডুবে গেলেন কলেজের পড়াশুনায়, খেলাধুলায় আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো নিয়ে। লেখকের ব্যস্ততায় সেই হোমসিক পালিয়া কোথায় গেল, তাকে আর খুঁজিয়া পাওয়া গেলনা।
তবে সেই “হোমসিক” শব্দটি আবার নতুন ভাবে লেখকের জীবনে ধাক্কা দিল। তাহা জাপানে উচ্চশিক্ষার জন্য যাইবার পরে। ক্যাডেট কলেজে শুধু পরিবার থেকে বিচ্যুত হবার কারণে হোমসিক হইয়া পড়িয়াছিলেন, কিন্তু জাপানের যাইবার পরে তাহার সাথে যুক্ত হইলো বন্ধু-বান্ধব সহ পুরো বঙ্গ দেশটিই। যার শক্তি পরিবার থেকেও অনেক অনেক বেশী।
জাপানে এই হোমসিকটি ম্যানেজ করাটা এই লেখকের জন্যে আরো কষ্টকর হইয়া পড়িলো। যাহা কৌশরে সামাল দিতে পারিয়াছিলেন- তাহা যুবক বয়সে সামাল দেয়াটা আরো বেশী কষ্টসাধ্য হইয়া গেল। কিভাবে সে কষ্টকর “হোমসিক”-কে সামাল দিলেন?- সেই কৌশলগুলো নিয়েই লেখক আজ হাজির হইয়াছেন আপনাদের নিবেদনে।