নারা স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে প্রথমেই চোখে পড়ল পুরনো স্টেশন ভবনটি। ১৯৩৪ সালে নির্মিত এই কাঠের ভবনটির স্থাপত্যশৈলী দূর থেকে দেখতে বৌদ্ধ মন্দিরের প্যাগোডার মতো লাগে, অথচ তাতে পাশ্চাত্য নকশার প্রভাবও স্পষ্ট। শত বছরের ঐতিহ্য বহন করা এই ভবনটিকে সংরক্ষণ করে আজ পর্যটক তথ্যকেন্দ্র ও একটি ক্যাফে হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, যার বারান্দায় এখনও পুরনো দিনের নকশার কাঠের সৌন্দর্য মেলে ধরে আছে। স্টেশনের চৌকাঠে পা দিয়েই আমার মনে হল যেন সময়ের দুই প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছি – এক পাশে অতীতের স্পর্শ, অন্য পাশে বর্তমানের গতি।
নতুন আধুনিক স্টেশন কমপ্লেক্সটি ঠিক এই ঐতিহ্যবাহী ভবনের পাশেই মাথা তুলেছে, যেখানে ২০১০ সালে ‘ভিয়েরা নারা’ নামে একটি অত্যাধুনিক শপিংমলও যুক্ত হয়েছে। বিশাল কাচঘেরা হলঘর, চলন্ত সিঁড়ি আর আধুনিক সুযোগ-সুবিধার ভিড়ে থাকা সত্ত্বেও কোথাও যেন নারার চিরাচরিত শান্ত আবহও টিকে আছে – আধুনিকতার মাঝেও শহরটি তার সংস্কৃতির শিকড়কে সম্মান জানিয়ে চলছে। বিশ বছর পর ফিরে এসে স্টেশনের এই রূপান্তর আমাকে বিস্মিত করল, তবে আশ্চর্যের বিষয়, সবকিছু অচেনা লাগছে না; নারায় সময় যেন থমকে থাকে না, বরং ধীর পায়ে মসৃণভাবে এগিয়ে যায়। মনে হল, এই শহরে পরিবর্তন এসেছে বটে, কিন্তু তার আত্মা আগের মতোই রয়ে গেছে।
স্টেশন থেকে বেশি দূর নয়, হাঁটতে হাঁটতে অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেলাম নগরকেন্দ্রের প্রাচীন বৌদ্ধ মন্দির, কোফুকুজির প্রাঙ্গণে। প্রথমেই দৃষ্টিতে এলো কোফুকুজির বিখ্যাত পাঁচতলা প্যাগোডাটি – প্রায় ৫০ মিটার উচ্চতার এই কাঠের প্যাগোডাটি জাপানের দ্বিতীয় সর্বোচ্চSuch প্যাগোডা, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যা নারার প্রতীক হয়ে আকাশের দিকে হাতছানি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কোফুকুজি ছিল একসময় নারার সপ্ত প্রধান “নান্তো শিচিদাইজি” (সাত মহান মন্দির)-এর একটি; অষ্টম শতকে জাপানের প্রথম স্থায়ী রাজধানী প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই এই মন্দির নগরীর ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক জীবনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল। যুগে যুগে রাজপরিবার থেকে সাধারণ জনগণ – সকলের প্রার্থনার পদচিহ্ন এই প্রাচীন প্রাঙ্গণের ধূলিতে মিশে আছে।
সকালবেলার মন্দির প্রাঙ্গণটি শান্ত ও শীতল। দু-একজন প্রয়াণোন্মুখ প্রবীণ ভক্তকে দেখলাম ধূপকাঠি জ্বালিয়ে প্রার্থনা করছেন; বাতাসে সুগন্ধী ধূপের ধোঁয়া ভেসে বেড়াচ্ছে, আর চারপাশে ছড়িয়ে আছে পুরনো কাঠের মৃদু গন্ধ। কোফুকুজির প্রাচীন কাঠামোর দিকে চেয়ে আমি অবাক হয়ে ভাবতে লাগলাম – জাপানের সংস্কৃতি ও শিল্পকলার যে আঁতুড়ঘর এই নারা শহর, তার জীবন্ত প্রমাণ যেন ফুটে আছে মন্দিরের প্রতিটি স্তম্ভে ও বিমে। সত্যিই, জাপানের সবচেয়ে প্রাচীন নির্মাণসমূহ এবং অমূল্য ঐতিহাসিক ধন এখনো এই শহরেই সযত্নে রক্ষিত আছে। ইতিহাসের গভীরতা অনুভব করে মন্দিরের পাথরের উঠোনে হাঁটতে হাঁটতে অতীতের সোনালী যুগের একটি ছবি যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল।
পাঁচতলা প্যাগোডাটির নীচে দাঁড়িয়ে আমি স্মৃতির ভারে কিছুক্ষণ মগ্ন রইলাম। বিশ বছর আগে তরুণ বয়সে যখন প্রথম নারা এসেছিলাম, এই কোফুকুজির প্যাগোডার সামনে দাঁড়িয়ে আমি প্রথম জাপানের প্রাচীন ঐতিহ্যের বিশালত্ব অনুভব করেছিলাম। আজ আবার সেই স্থানে এসে দেখি প্যাগোডাটি একইভাবে আকাশ ছুঁয়ে আছে, শুধু আমার জীবন থেকেই দু’দশক সময় পেরিয়ে গেছে। মন্দির চত্বরের একপাশে কয়েকটি হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে, যেমনটা তখনও দেখেছিলাম; সেই স্মৃতিময় সকাল আর এই বর্তমান মুহূর্ত যেন একে অপরের সাথে মিশে যাচ্ছে। কোফুকুজির নীরব প্রাঙ্গণে দাঁড়িয়ে আমার মন অতীত ও বর্তমানের মাঝখানে ঝুলে রইল – সময় যেন এখানে এক চক্রাকার প্রবাহ, যা আমাকে শিকড়ের কাছে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
কোফুকুজি মন্দিরের প্রাঙ্গণ পেরিয়ে আরও ভিতরে, সবুজে ঘেরা নারা পার্কের পথে এগোতেই চারপাশে হরিণদের চরণধ্বনি শুনতে পেলাম। অল্পক্ষণেই কয়েকটি হরিণ আমার দিকে এগিয়ে এলো। নারার এই শিকা প্রজাতির হরিণগুলো মানুষপ্রিয়; পার্কের কাছে বিক্রি হওয়া বিশেষ “শিকা-সেনবে” নামের বিস্কুট কিনে তাদের দিকে বাড়িয়ে ধরতেই একটি হরিণ ভদ্রভাবে মাথা নুইয়ে এগিয়ে এসে আমার হাত থেকে খাবার নিল। নরম ঠোঁট দিয়ে আঙুল ছুঁয়ে যখন হরিণটি মুচমুচে বিস্কুটটা খেতে লাগল, তার উষ্ণ শ্বাস আর হালকা বুনো গন্ধ অনুভব করে হৃদয়ের ভেতর একটা আলাদা আনন্দ জেগে উঠল। বিশ বছর আগেও এমনই এক সকালে তরুণ আমি হরিণদের খাওয়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়েছিলাম – সেই স্মৃতিটা হরিণটির চকচকে চোখে নিজের প্রতিফলন দেখে হঠাৎই চোখের সামনে ফিরে এলো। মাথা নিচু করে শুকনো ঘাস চিবোতে থাকা এই সরল প্রাণীদের মাঝে দাঁড়িয়ে নিজেকেও যেন অনেক বিনম্র ও শান্ত লাগতে শুরু করল।
স্থানীয় এক পুরাণ মনে পড়ে গেল: কথিত আছে, প্রাচীনকালে তাকেমিকাজুচি নামে বজ্রের দেবতা ইবারাকির কাশিমা মন্দির থেকে একটি শুভ্র হরিণের পিঠে চড়ে নারা নগরীতে আগমন করেছিলেন। সেই থেকেই নারা পার্কের হরিণগুলোকে কাসুগা-তাইশা শিন্তো মন্দিরের দেবতার পবিত্র দূত হিসেবে মানা হয় এবং অধিবাসীরা এদের সযত্নে রক্ষা করে আসছেন – এই দীর্ঘ তেরো শতাব্দী ধরেই তারা “দেবতার বার্তাবাহী” রূপে শ্রদ্ধেয়। আজ প্রায় বারোশোর বেশি হরিণ এই পার্ক এবং আশেপাশে অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছে, মানুষ ও প্রকৃতির সহাবস্থানের এক অনন্য উদাহরণ হয়ে। একটা সময় শিকার ও উন্নয়নের চাপে জাপানের অন্য অনেক জায়গা থেকে হরিণ বিলুপ্ত হয়ে গেলেও, নরার জনগণ এই পবিত্র হরিণদের রক্ষায় নিজেদের উৎসর্গ করেছে। ইতিহাস ও আধুনিকতার সেতুবন্ধন রচনা করে এই হরিণেরা এখন নগরীর প্রতীক – ছোট্ট শিশুরা এগুলোকে হাত বাড়িয়ে খাওয়াচ্ছে, পর্যটকেরা আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আর হরিণেরা নির্বিবাদে মানুষের সঙ্গ উপভোগ করছে। মানুষের সাথে এদের এই মৈত্রীর দৃশ্য দেখে মনে হলো, সত্যিই এই শহরে সহাবস্থান আর শান্তির বাণী চিরন্তন।
হরিণদের আলিঙ্গনছাড়া সেরে এবার নারার আরেক মহাতীর্থের পথে পা বাড়ালাম। বিশাল তোদাইজি (তোদাই-জি) মন্দিরের দিকে এগোতেই প্রথমে পড়ল তার সুবিশাল দক্ষিণ দ্বার নন্দাইমোন-এর সম্মুখীন। এই প্রবেশদ্বারের দুই পাশে কাঠের নির্মিত দুই বিরাট দ্বাররক্ষী (নিও) দেবতার মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে, যেগুলো যেন শতাব্দী প্রাচীন মর্যাদায় আগত সবাইকে অভিবাদন জানাচ্ছে। প্রাচীন কাঠের তোরণের ফাঁক দিয়ে ভেতরে পা রেখেই নজরে এলো দাইবুতসুদেন – তোদাইজি মন্দিরের প্রধান হলঘর, যার আকার ও বিস্তার দূর থেকে একটি পাহাড়ের মতো মনে হয়। যত সামনে এগোলাম, এর বিশালত্ব তত স্পষ্ট হতে লাগল; অনুভব করলাম মানুষের তুলনায় স্থাপনাটির আকার কতটা অপরিমেয়।
প্রধান হলটির উচ্চতা প্রায় ৪৮ মিটার; এটিই বিশ্বের সর্ববৃহৎ কাঠের নির্মিত স্থাপনা বলে পরিগণিত হয়। বিশাল কাঠের দরজা পেরিয়ে হলের ভেতর প্রবেশ করতেই আলো-আঁধারিতে অবস্থিত এক মহাসমুদ্র ব্যাপ্তি অনুভব করলাম – সামনে বিরাজ করছে বিশালাকার ব্রোঞ্জ নির্মিত বৈরোচন বুদ্ধের (দাইবুতসু) মূর্তি। এই সুবর্ণ-আবৃত বুদ্ধমূর্তিটি জাপানের সর্ববৃহৎ বুদ্ধ মূর্তি এবং বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ ব্রোঞ্জ নির্মিত প্রতিমা। মন্দিরের উঁচু ছাদ পর্যন্ত পৌঁছানো প্রায় ৫০ ফুট উচ্চতার এই মহাবুদ্ধের প্রশান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে এক গভীর শান্তি অনুভব করলাম; তার অর্ধনিমীলিত দৃষ্টি যুগের পর যুগ অসংখ্য ভক্তের শ্রদ্ধা প্রত্যক্ষ করে এসেছে। চারদিকে ধূপের সুগন্ধ ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী ঘুরছে, কোথাও দূরে একটানা ঘণ্টাধ্বনির প্রতিধ্বনি প্রচুর স্তম্ভের হলঘরে গমগম করতে করতে যেন সময়কে ধীর করে দিচ্ছে। অন্যান্য দর্শনার্থীরা নীরবে এই বিশাল মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে আছে – কেউ প্রার্থনায় মগ্ন, কেউ মূর্তির ঐতিহাসিক মহিমা পড়ে শোনাচ্ছেন তাদের সঙ্গীদের। আমার চারপাশে সেই নিস্তব্ধ বিস্ময়ের আবহ আমাকে আরো নিবিষ্ট করে তুলল।
বিশ বছর আগে যখন প্রথম তোদাইজি দর্শন করতে এসেছিলাম, মহাবুদ্ধের এই বিশালত্ব আমাকে হতবাক করেছিল – আজ দীর্ঘদিন পর আবার একইরকম মুগ্ধতা নিয়ে আমি তার সম্মুখীন হলাম। জীবনে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে এ동안, কিন্তু এই অটল ব্রোঞ্জমূর্তির শান্ত অভিব্যক্তি বিন্দুমাত্র বদলায়নি; সে তার অমোঘ উপস্থিতিতে মানবজাতির বহু প্রজন্মের পদচিহ্নের সাক্ষী হয়ে বিরাজমান। কিছুক্ষণ ধ্যানমগ্নের মতো দাঁড়িয়ে থেকে অনুভব করলাম, আমার নিজের জীবনের ক্ষুদ্রতা এবং এই মহাবুদ্ধের চিরন্তন প্রকৃতি কোথাও যেন মিলিয়ে যাচ্ছে। ভক্তি আর ভাবনায় ডুব দিয়ে অবশেষে যখন বাইরে বেরোলাম, মনে হল যেন হৃদয়টা এক অপূর্ব শান্তি ও শক্তিতে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে – নারার বুকে এই অসামান্য ঐতিহ্যের সান্নিধ্যে কাটানো মুহূর্তগুলো আমার অন্তরে অমূল্য স্মৃতি হয়ে রয়ে যাবে।
মন্দির দর্শন শেষে শরীরে ক্লান্তি অনুভব হচ্ছিল। দুপুর গড়িয়ে আসায়, পার্কের কাছের একটি সরু গলির মোড়ে ছোট্ট এক সোবা নুডলসের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। দোকানের ঝুল বারান্দায় পুরনো কাঠের সাইনবোর্ডে লেখা নামটা চোখে পড়তেই স্মৃতির পাতায় একটা ঝিলিক খেলল – কুড়ি বছর আগে প্রথম আগমনে এই দোকানেই একবার খেয়েছিলাম! ভেতরে ঢুকে দেখি সেটিই যেন আছে আগের মতো: লালচে পুরনো কাঠের টেবিল-বেঞ্চ, দেয়ালে স্থানীয় উৎসবের বিবর্ণ পোস্টার, কোণায় এক বিশীর্ণ টেলিভিশন মিউট করে চলেছে। রান্নাঘরের পার্টিশনের আড়াল থেকে বছর ষাটেকের এক জাপানি মহিলা – হয়তো মালকিন – উঁকি দিয়ে সাদর হাসলেন। আমাকে চিনতে পারেননি নিশ্চয়, কিন্তু তাঁর আন্তরিক অভ্যর্থনায় নিজেকে তখনই আপন কেউ বলে মনে হলো। ছোট ঘরটির উষ্ণ পরিবেশ, দেয়ালে ঝোলানো পাতা-খসখসে ক্যালেন্ডার আর ধোঁয়াটে আলো দেখে মনে হল যেন পুরনো জাপানে সময় কাটাচ্ছি।
অল্পক্ষণ পরেই ধোঁয়া ওঠা এক বাটি গরম সোবা এসে হাজির হলো আমার টেবিলে। সুপের হালকা ঝাঁঝালো সুঘ্রাণ আর তাজা পেঁয়াজকুচি ও সামুদ্রিক শৈবালের সুবাস নাকে এল। হাতজোড় করা ধন্যবাদ জানিয়ে এক চুমুক নিয়ে দেখলাম, সোনালী শোর্বাসুদ্ধ ঝোলটা গলা বেয়ে নামতেই সমস্ত ক্লান্তি যেন মুছে গেল। মিহি আর লম্বা এই সোবা নুডলগুলো জাপানি সংস্কৃতিতে দীর্ঘায়ুর প্রতীক হিসেবে গণ্য হয়, আর আজ এর প্রতিটি গ্রাসে আমি যেন আমার দীর্ঘদিনের ফেলে আসা স্মৃতিগুলোকেও নতুন করে আস্বাদন করছি। সোবার তরল সূপে ডুব দেওয়া প্রতিটি নুডল সুতো যেন আমাকে অতীত ও বর্তমানকে একসাথে জুড়ে দেয়। দুই দশক আগের স্বাদ আর এখনকার স্বাদে তেমন কোনো ফারাক নেই – সেই একই ঘরোয়া অপূর্ব স্বাদ, যা মুহূর্তে আমাকে কালের গর্ভে হারিয়ে যাওয়া অতীতের দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। তোদাইজি মন্দিরের আধ্যাত্মিক পরিবেশে অন্তর যেভাবে পূর্ণ হয়েছিল, এ দেশের সহজ-সুন্দর খাবারের স্বাদেও তেমন এক সরল আনন্দ অনুভব করলাম। যেন অপূর্ব এক প্রসাদ লাভ করলাম – শুধুই পেট ভরল না, মনও ভরে গেল।