সিঙ্গাপুরের ভোরের আকাশে উড়োজাহাজে পা রাখার পর থেকেই আমার বুকের ভেতর উত্তেজনার ঢেউ খেলছিল। জানালার ধারে বসে মেঘপুঞ্জ পেরিয়ে যেতে যেতে দিগন্তে চোখ রেখেছিলাম। দীর্ঘ নীল সমুদ্র চিরে আমাদের বিমান এগিয়ে চললো দক্ষিণ-পশ্চিমে, নিরক্ষরেখার উষ্ণ অঞ্চলের দিকে। প্রায় চার ঘন্টার উড়ানে হঠাৎ নিচের ফিরোজা জলরাশির বিস্তারে সাদা ফেনার মালা দেখা দিল – প্রথমে ভেবেছিলাম মেঘের ছায়া, কিন্তু তা নয়। ভাল করে চোখ মেলে দেখি অসংখ্য ক্ষুদ্র দ্বীপ জেগে উঠেছে সবুজাভ জলরাশির বুকে, যেন আকাশ থেকে মুক্তোর মালা ছিঁড়ে ছড়িয়ে পড়েছে নীল সাগরে। এক একটি দ্বীপ যেন সবুজ রত্নখণ্ড, চারপাশে প্রবালের প্রাচীর জড়ানো ফিকে নীল লেগুন। বিমানের ডানায় রোদ ঝিলমিল করে উঠল, আমার হৃদয়ও সেই মুহূর্তে কেঁপে উঠল অপার্থিব সৌন্দর্যে।
বিমানবালা ঘোষণা করলেন, আমরা মালদ্বীপে অবতরণ করতে যাচ্ছি। জানালা দিয়ে নিচে তাকিয়ে দেখি দূরে একটি প্রধান দ্বীপ – রাজধানী মালে, ছোট্ট দ্বীপজুড়ে রঙিন ঘরবাড়িতে ঠাসা এক শহর। মনে হলো নীল সমুদ্রের মাঝে রঙিন খেলনার শহর বসানো। চারপাশে আরও দ্বীপ ছড়ানো; কোনোটায় একটা লম্বা রানওয়ে চোখে পড়লো – বুঝলাম ওটিই হুলহুলে দ্বীপের বিমানবন্দর, যেখানে নামবো। বিমান ধীরে ধীরে নিচে নামার সময় প্রবাল-প্রাচীর ঘেরা লেগুনের ফিরোজা জল স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল, আর তার গা ঘেঁষে উড়ে যাচ্ছিল কিছু পাখি – কাছ থেকে বোঝা না গেলেও শঙ্খচিল বা ফ্লাইং ফিশ হতে পারে। মনে হচ্ছিল, নাকের পাতায় এখনই লেগেছে নোনতা বাতাসের ছোঁয়া আর চেনা অচেনা ফুলের মিষ্টি গন্ধ।
চাকা মাটি ছোঁয়ার সাথে সাথে আমার এডভেঞ্চারের সূচনা। মালদ্বীপ – নামটার মধ্যেই মিশে আছে অজস্র দ্বীপের মালা। সত্যিই, প্রায় ১,২০০টি ছোট ছোট সমতল বালুকাদ্বীপ নিয়ে গঠিত এই প্রবাল রাষ্ট্র, যার মধ্যে মানুষের বসতি রয়েছে মাত্র প্রায় ২০০টিতে। বাকি অসংখ্য দ্বীপ জুড়ে আছে প্রবালের বেষ্টনী ঘেরা লেগুনে বনভূমি ও ফাঁকা ভূখণ্ড, বা বিলাসবহুল রিসর্টের নিবাস। আকাশ থেকে মালদ্বীপের এই প্রবাল দ্বীপমালা দেখে মনে হলো, স্বপ্নের রাজ্যে প্রবেশ করছি।
বিমান থেকে নামতেই নরম উষ্ণ হাওয়ার ঝাপটা মুখে লাগল। চারপাশে নারকেল গাছের সবুজ পাতা দুলছে হাওয়ায়। ইমিগ্রেশন ও লাগেজ সংগ্রহ সেরে ছোট্ট বিমানবন্দর ভবনের বাইরে বেরিয়ে এলাম। এখান থেকে জলপথে আমাকে রিসর্ট দ্বীপে পৌঁছতে হবে। টার্মিনালের বাইরে স্বচ্ছ সবুজাভ জলের উপর সারি সারি স্পিডবোট বাঁধা, আর খানিক দূরে ধবধবে সাদা একটি ফেরি নৌকা – সেগুলোই স্থানীয়দের চলাচলের ধোনি (ঐতিহ্যবাহী মালদ্বীপী নৌকা)। বুকভরে বাতাস নিলাম – নোনতা সমুদ্রের গন্ধের সাথে কোথা থেকে ভেসে আসা ফুলের মিষ্টি ঘ্রাণ মিশে আছে। চারপাশে নানা দেশ থেকে আসা পর্যটকের ভিড়, সবাই মোহিত দৃষ্টিতে এই স্বর্গে আগমনের ক্ষণ উপভোগ করছে।
একজন মালদ্বীপি গাইড এগিয়ে এলেন, মাথায় ডোরা কাপড়ের টুপি এবং পরনে সাদা লুঙ্গির মতো ধুতি – এদেশের ঐতিহ্যবাহী পুরুষ পোশাক। মুখে উষ্ণ হাসি নিয়ে তিনি বললেন, “আসসালামু আলাইকুম, স্বাগতম।” আমি মুচকি হেসে সেখানেই বাংলায় জবাব দিলাম, কিন্তু আশেপাশের সবাই ইংরেজি ও নানা ভাষায় কথা বলছে বলে তিনি বুঝতে পারলেন না। গাইড ভাঙা ইংরেজিতেই জিজ্ঞেস করলেন যাত্রা কেমন হল। খানিক বাদে আমি স্পিডবোটে উঠে বসলাম, গন্তব্য – একটি বিলাসবহুল রিসর্ট দ্বীপ, যেখানে আমার প্রথম রাত কাটবে।
স্পিডবোট ছুটে চলল সবুজ-নীল পানির বুক চিরে। পানির এমন রং আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি – কোথাও গভীর নীল, কোথাও এতটাই স্বচ্ছ ফিরোজা যে নিচের প্রবালপ্রাচীরের আভাস মেলে। দুপাশে মাঝে মাঝে বালুকাবেলা ভেসে উঠছে, কোথাও আবার সবুজ বৃক্ষরাজি ঘেরা দ্বীপ, কোনোটিতে সুউচ্চ একটি বর্ণিল বাতিঘর নজরে এলো। বাতাসে লবণের স্বাদ, জলীয় বাষ্পে চুল ভিজে আসছে একটু একটু করে।
মনে পড়ল, কোথাও পড়েছিলাম এ দেশটির প্রতিটি দ্বীপই মূলত প্রবালের তৈরি প্ল্যাটফর্মের উপর গড়ে ওঠা সমতল ভূমি। প্রবাল দ্বীপ বলেই এদের উচ্চতা খুব কম, অনেক দ্বীপের মাটি সাগরপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দেড়-দুই মিটার উঁচু। ভাবতে অবাক লাগে, এত নাজুক ভূখণ্ডের উপরও মানুষের সভ্যতা কত সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছে! স্পিডবোট যখন রিসর্টের জেটিতে ভিড়ল, রোদ তখন মাথার উপর, সমুদ্রের জল ক্রিস্টালের মত ঝকঝকে করছে।
স্পিডবোট থেকে নামতেই রিসর্ট দ্বীপের ঘাটে কয়েকজন হাসিমুখ কর্মী আমাকে স্বাগত জানালেন। একজন হাতে ঠান্ডা নারকেলের পানীয় বাড়িয়ে দিলেন – সবুজ ডাবের ভেতর স্ট্র দিয়ে মিষ্টি শীতল জল। চারদিকে অপার শান্তি, শুধু নারকেল পাতার মৃদু সরসর আর দূরে প্রবাল প্রাচীরে ঢেউ ভাঙার নরম গর্জন শুনতে পাচ্ছি। পুরো দ্বীপটি একটি বিলাসবহুল রিসর্ট; ছোট্ট ভূখণ্ডে সারি সারি পামগাছের ছায়ায় ছিমছাম কাঠের কটেজ, কিছু কটেজ আবার উঁচু খুঁটির উপর সমুদ্রের বুকে দাঁড়িয়ে আছে – যাকে বলে ওভার-ওয়াটার বাংলা। বালুকাবেলায় পা রাখতেই টের পেলাম, বালির দানাগুলো কী অসম্ভব সূক্ষ্ম আর সাদা – প্রবালের গুঁড়ো থেকে তৈরি বলে তুলোর মতো নরম লাগে পায়ে।
দিনের আলো ঝলমল করছে। জলের দিকে তাকিয়ে দেখি রঙের কী খেলাই না চলছে – কিনারে একদম স্বচ্ছ, অ্যাকোয়ারিয়ামের মত সবুজাভ জল; একটু দূরে গাঢ় ফিরোজা; তার পরে গভীর নীল সাগর দিগন্তের সাথে মিশে গেছে। লেগুনের জলে রোদ পড়ে রুপোলি ঝিলিক উঠছে, এখানে-সেখানে ছোট ছোট রঙিন মাছ লাফিয়ে উঠে আবার ডুবে যাচ্ছে। রিসর্টের একজন কর্মী – নাম আহমেদ – আমার লাগেজ নিয়ে এগিয়ে চললেন কটেজের দিকে। কথা বলে জানলাম, তিনি নিকটস্থ এক স্থানীয় দ্বীপের মানুষ, চাকরির কারণে মাসের পর মাস রিসর্টে থাকেন। আহমেদ হেসে বললেন, “কাল আমার গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি ছুটিতে। চাইলে আপনিও চলুন, আসল মালদ্বীপ দেখতে পাবেন।” আমি একটু অবাক হলাম – জিজ্ঞেস করলাম, “এখানে যা দেখছি তাই তো মালদ্বীপ!” আহমেদ মাথা নেড়ে বললেন, “না সাহেব, এই রিসর্ট স্বপ্নের মতো হলেও এখানে আমাদের সাধারণ জীবনের চিত্র নেই। লোকাল আইল্যান্ডে গেলে আমাদের গ্রাম, আমাদের মানুষ, আমাদের সংস্কৃতি – সবকিছু সত্যিকার মালদ্বীপের স্বাদ দেবে আপনাকে।”
তার কথায় কৌতূহল জাগল মনে। বিলাসিতা উপভোগ তো করবই, তবে সত্যিকারের মালদ্বীপের জীবনও দেখতে চাই। এদিকে রিসর্টের সৌন্দর্য নিজস্ব মায়ায় আমাকে মোহিত করছিল। কটেজে ঢুকে দেখি কাঠের বারান্দা সাগরের দিকে প্রসারিত, নিচে স্বচ্ছ পানিতে কখনও রঙিন মাছ ভেসে যাচ্ছে। ঘরের ভেতর ঝকঝকে পরিপাটি, বিছানায় ফুল দিয়ে স্বাগত বার্তা লেখা। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে বিকেলের দিকে সৈকতে হাঁটতে বেরুলাম। সূর্য পশ্চিম আকাশে ঢলেছে, কোমল আলো নারকেল পাতায় ঝিকমিক করছে। সমুদ্রতীরে ছাতা পেতে কিছু পর্যটক রৌদ্রস্নান করছে, কেউ কেউ স্নরকেলিংয়ের সরঞ্জাম পরে পানিতে মাথা ডুবিয়ে প্রবাল আর মাছ দেখছে। আমি জলকল্লোলে পা ডুবিয়ে হাঁটতে থাকলাম কিনারা ঘেঁষে। পায়ের কাছে ছোট ছোট শামুক আর বিচ্ছুরিত প্রবালের টুকরো। ঢেউগুলো আলতো করে পায়ে এসে লাগছে, যেন সাগর নিজে শীতল চুমু এঁকে দিচ্ছে।
নির্জন সৌন্দর্যের মাঝে হঠাৎ তীরে একপ্রান্তে সুর ভেসে এলো। সন্ধ্যা নামছে, রিসর্টে বোধহয় কিছু আয়োজন শুরু হবে। সত্যিই, কিছুক্ষণ পর সৈকতের একপাশে খোলা জায়গায় গোল হয়ে পর্যটকরা বসতে শুরু করলেন, মাঝখানে মাটিতে প্রদীপের আলো জ্বলছে। কাছে যেতেই স্পষ্ট হল – এটি ঐতিহ্যবাহী মালদ্বীপী সঙ্গীত ও নৃত্যের পরিবেশনার আয়োজন। কয়েকজন স্থানীয় বাদ্যযন্ত্রী বড় বড় হাত-ঢোল নিয়ে বসলেন, যেগুলোকে বলে বোদু বেরু – ধিভেহি ভাষায় যার অর্থ “বড় ঢোল”। প্রায় পনেরোজনের একটি দল – তিনজন ঢোলবাদক, একজন প্রধান গায়ক, আর বাকিরা নৃত্য ও কোরাসে অংশ নিলেন। ঢোলের গভীর তাল লয়ের সাথে আস্তে আস্তে গান শুরু হল – সুরটি ধীর লয়ে আরম্ভ হয়ে ক্রমেই তীব্র হতে থাকল। গায়ক ধিভেহি ভাষায় কোনো প্রাচীন কাহিনি গাইছেন, ভাষা না বুঝেও আমি তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম। ঢোলের তাল ধীরে ধীরে দ্রুত হচ্ছে, দলের সদস্যরা কোমর দুলিয়ে হাততালি দিয়ে তালে নাচছেন। ক্রমে সঙ্গীতের গতি ও আওয়াজ এমন চূড়ান্ত উচ্ছ্বাসে পৌঁছাল যে মনে হলো হৃদযন্ত্রও সেই তালে লাফাচ্ছে। নারকেল-ছায়া অন্ধকার সৈকতে জোছনার আলো আর এই উদ্দাম নাচ-গান – মুহূর্তটি যেন শতাব্দীপ্রাচীন কোনো আধ্যাত্মিক উৎসবের আতিশয্য। শেষের উন্মাদনা-ছোঁয়া মুহূর্তে এসে ঢোল থামতেই চারদিক থেকে করতালির ঝড় উঠল। আমি মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বসে রইলাম কিছুক্ষণ, মনে হচ্ছিল মালদ্বীপের আদিম আত্মা এই বোদু বেরুর ছন্দেই ধ্বনিত হলো।
সে রাতে ডিনারে রিসর্টের রেস্টুরেন্টে নানান পদ সাজানো ছিল – স্থানীয় ফিশ কারি থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক নানা খাবার। আমি বেছে নিলাম এক প্লেট মাস হুনি – শস্যদানার মতো কুচানো টুনা মাছ, নারকেল, পেঁয়াজ আর মরিচ মিশিয়ে সালাদের মতো খাবার, সাথে মালদ্বীপী রুটি রোশি। নারকেলের মিষ্টি সুবাস আর সাগরের তাজা মাছের স্বাদ জিভে লেগে রইল। ডিনার সেরে জেটির দিকে হাঁটতে গেলাম। মাথার উপর অসংখ্য তারা ঝিকিমিকি করছে, দূরে কোথাও একটি নৌকা থেকে টিমটিমে আলো ভাসছে। জলের ধারে এসে বসতেই দেখলাম অদ্ভুত এক দৃশ্য – সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন নীল আলো নিয়ে তীরে এসে আছড়াচ্ছে! প্রথমে ভাবলাম চোখের ভুল, এরপর বুঝলাম পানির ভেতর অগণিত জ্বলজ্বলে বিন্দু – ঠিক যেন আকাশের তারারা নেমে এসেছে সাগরের বুকে। জীবন্ত প্ল্যাঙ্কটনের জৈব-দীপ্তির এই খেলা, যাকে “সী অব স্টারস” বলা হয়, মালদ্বীপের কিছু দ্বীপে মাঝেমধ্যেই দেখা যায়। নরম ঢেউ যখন তীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি তরঙ্গে অসংখ্য নীল আলো জ্বলে উঠছে আর নিভছে। অন্ধকার রাতে এ এক পরীদের জাদুকরি নৃত্য যেন। আমি নিঃশব্দে গভীর শ্বাস নিলাম – জীবনে এই ক্ষণিক অলৌকিক সৌন্দর্যটুকু কখনো ভুলব না।
রাতে নিজের কটেজের বারান্দায় বসে সামনের নিঝুম সমুদ্র আর আকাশের মিলনরেখার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দূরে কোনো মাছধরা ট্রলারের আলো দুলছে। মাথার উপর নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে কয়েকটি তারাও দেখা যাচ্ছে। আজকের স্বপ্নসম অভিজ্ঞতার মধ্যেও মনে পড়ছিল আহমেদের কথাটি – রিসর্টের জৌলুসের আড়ালে যে আরেক মালদ্বীপ আছে, যেখানে স্থানীয় মানুষের বাস্তব জীবন প্রবাহমান। বিলাসিতার পৃথিবী থেকে বেরিয়ে সেই জীবনের স্বাদ নেওয়ার আগ্রহ আমার বেড়ে চলল। ঢেউয়ের মৃদু শব্দ আর দূরের কোনো রাতচরা পাখির ডাকের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, পরদিনের অভিযানের স্বপ্ন চোখে নিয়ে।
পরদিন সকালে সূর্য ওঠার আগেই আমি তৈরি হলাম একটি স্থানীয় দ্বীপের পথে রওনা দেওয়ার জন্য। আহমেদ তার দ্বীপ থুলুধুতে আমন্ত্রণ জানিয়েছে আমাকে – এটি উত্তর মালে অ্যাটলের বাসিন্দাপূর্ণ একটি ছোট্ট দ্বীপ। রিসর্টের স্পিডবোটেই সে আমাকে নিয়ে যাবে, আর ফাঁকে নিজ বাড়িতেও ঘুরে আসবে। ভোরের আবছা আলোয় আমরা রওনা হলাম; পিছনে ফেলে আসলাম বিলাসবহুল স্বপ্নদ্বীপ, সামনে উদ্ভাসিত হলো এক নতুন দিনের সম্ভাবনা।
মাত্র আধাঘণ্টার মধ্যে সবুজে ঘেরা ছোট্ট দ্বীপটির ঘাট দেখা দিল। এখানে চকচকে জেটির বদলে কাঠের ছোট পন্টুনের সাথে আমাদের নৌকা বেঁধে ফেলা হল। পা রাখতে মনে হল একেবারে আলাদা জগতে প্রবেশ করেছি – এখানে পর্যটকদের কোলাহল নেই, আছে স্থানীয় জীবনধারার সহজ সরল ছন্দ। বালির রাস্তা, দুপাশে নারকেল, সুপারি আর প্যান্ডানাস গাছের ছায়া। নোঙর করা রঙিন মাছধরা নৌকাগুলোর সারি দেখে বুঝলাম জেলেপাড়া কাছেই। দূরে কয়েকজন জেলে ভোরের ধরা মাছ নামাচ্ছেন; রূপালি টুনা মাছগুলো ঝুড়িতে উঁকি দিচ্ছে। পাশে দাঁড়ানো একদল ছেলে মুগ্ধ হয়ে সে দৃশ্য দেখছে – হয়তো ভবিষ্যতে তারাও সমুদ্রে যাবে মাছ ধরতে।
চারদিকে তাকিয়ে এই দ্বীপের শ্বাস-প্রশ্বাস অনুভব করার চেষ্টা করছিলাম। মসৃণ ধূসর প্রবাল পাথর আর সিমেন্ট দিয়ে বানানো ছোট ছোট ঘরবাড়ি, উঠোনে ঝুলছে রঙিন কাপড় শুকোতে। কোথাও নারীরা আঙিনায় ঝাঁটা দিচ্ছেন, কেউ রাস্তার ধারে নারকেলের ছোবড়া থেকে দড়ি বানাচ্ছেন, কারো হাঁড়িতে ভাপ ওঠা মাছ-নারকেলের তরকারির গন্ধ বেরোচ্ছে। শিশুদের কচি কণ্ঠের হাসি শুনতে পেলাম – দেখি একটি উন্মুক্ত মাঠে তারা নারকেলের পাতা জড়িয়ে বানানো বল দিয়ে ফুটবল খেলছে উচ্ছ্বসিত ভঙ্গিতে। তাদের নিষ্পাপ হাসি আর মুক্ত উচ্ছলতা দেখে আমার মন ভরে গেল।